যুদ্ধকালীন মেডিকেল ক্যাম্প
মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে ডাক্তারদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। সরাসরি যুদ্ধ হয়তো অনেকেই করেননি কিন্তু যারা যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা দেবার জন্য দেশের অনেক স্থানেই গড়ে উঠেছিলো মেডিকেল ক্যাম্প।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আহতদের জটিল ও সমন্বিত চিকিৎসাগুলো দেওয়া হতো মূলত ভারতীয় কোনো হাসপাতালে। জরুরি প্রয়োজনে দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা এই অস্থায়ী ক্যাম্প গুলো সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানোর সঙ্গে যোগ হয় শত শত মানুষের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাও, যাঁদের হাসপাতালে নিয়ে সেবা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন এগিয়ে এসেছিলেন পল্লী চিকিৎসক, কম্পাউন্ডার বা খুব সাধারণ মানুষ। এমন অসংখ্য সহমর্মিতার গল্পই মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।
রাজবাড়ী জেলার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেডিক্যাল ক্যাম্পে দায়িত্ব নেন ডা. গোলাম মোস্তফা। তার ভূমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস' এক অমূল্য দলিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের বহু স্তরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা, গবেষণা চলছে। সবচেয়ে কম আলোচিত মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা।
যুদ্ধের ৫২ বছর হয়ে গেল এ পর্যন্ত এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি। শ্রদ্ধা জানানো হয়নি জীবনের মায়া ত্যাগ করে যারা সেবা দিয়েছেন সেই সব মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান অযত্নে অসচেতনায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজবাড়ী যুদ্ধকালীন আহত কমান্ডার বাকাউল আবুল হাসেম এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তখন অনেক জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। আমি যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসাবে আমার সঙ্গীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সিদ্বান্ত নেই রামকান্তপুর আমার ক্যাম্পের পাশে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করবো। সিদ্বান্ত মোতাবেক তৎকালীন সিভিল সার্জন হুমায়ন কবির এবং ডাঃ গোলাম মোন্তফা এগিয়ে আসলেন। হাসপাতালে সেবা দেয়া দুরূহ হওয়ার কারণে প্রায় লোক চক্ষুর আড়ালে মাটিপাড়া স্কুলের একটি ঘরে মেডিক্যাল ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়। ডাক্তার হিসাবে গোলাম মোস্তফা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিদিন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে থাকেন। ডাঃ মোস্তফা সবচেয়ে বড় অপরেশনটা করেন ইলিয়াস আলীর। তার মাথার মধ্যে গুলি লেগে এখানেই চিকিৎসা করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানিতে নেয়া হয়।
রাজবাড়ী জেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের মাটি পাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জড়িত একমাত্র মেডিকেল ক্যাম্পটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। এই স্বার্থ সেবা হাসপাতালটি এখন বেথুলিয়া সরকারী প্রাথমিক হিসাবে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে।
প্রদক্ষদর্শী হোসেন মৃধা এখন তার বয়স ৭৮ তার স্মৃতি চারণে বলেন এই বেথুলিয়া গ্রাম তখন ঝোপ ঝাঁড়ে ভরা ছিল। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে বিহারীদের আনোগোনা ছিলো। কোন মুক্তিযোদ্ধা ভয়ে সেখানে যেতে পারতো না। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হতো গোপনে। বেথুলিয়া স্কুলটিতে সেবা দেয়া হতো। আমার বয়স তখন ২৫ বছর। আমরা গ্রামের অনেক মানুষ ডাক্তারদের সাহায্য করতাম। প্রতিদিন কেউ না কেই আহত হয়ে এই হাসপাতালে আসতো।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক