ভাতের চেয়ে যখন আলু দামি
নিত্যপণ্যের বাজারে স্মরণকালের মধ্যে এমনটা ঘটেছে কিনা সেটা কেউ মনে করতে পারছে না। বাজারে আলুর দাম মাঝারি ও মোটা চালের দরকেও ছাড়িয়ে গেছে। বাঙালির জীবনে আলু আর ভাতের সম্পর্ক এমন যে, কথায় আছে, 'আলু সেদ্ধ-ভাতে বাঙালি'।
কিন্তু সেই আলু এখন অনেক দামি। পাতে তুলতে ভাবতে হচ্ছে মানুষকে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। তবে কোথাও কোথাও ৮০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। তাই ভাতের সাথে একটুখানি আলু সেদ্ধ জোগাড় করাও এক মাথা ব্যথা এখন।
আলুর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বহু পরিবারে। অবস্থাটা এমন যে দাম বেশি বলে বীজ আলুও চলে আসছে বাজারে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং যে কোন মূল্যে বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এবার ডিসেম্বরে শুরুতে মৌসুম ভিত্তিক আলুর উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
আচমকা কেন বাড়ল আলুর দাম? সাধারণ মানুষের দাবি, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে প্রশাসনের নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া, আলু ব্যবসায়ীদের একাংশ হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না। যার ফলে, বাজারে আলুর সঙ্কট তৈরি হতেই দাম বাড়তে শুরু করেছে।
বাজার মনিটরিং-এ যে দুর্বলতা আছে সেটা বোঝা যায়। কারণ মৌসুমের শুরু থেকেই এবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে আলুর বাজার। কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ৯০ পয়সা। খুচরায় প্রতি কেজির যৌক্তিক দাম ৪৬ টাকা। অথচ ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজারে গত এক সপ্তাহে আলুর দাম নতুন করে ১০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০-৭৫ টাকায় এবং কোথাও কোথাও ৮০ টাকায়।
আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে দুই মাস আগে পণ্যটির আমদানি শুল্ক কমিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আমদানিও হয়েছে। তবে বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি; বরং দাম বেড়েছে। এ অর্থ হলো শুল্ক হ্রাসের সুবিধা জনগণ পায়নি এবং সরকারও তার আয় হারিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে হিমাগারে থাকা আলুর সরবরাহ শেষের দিকে। পাইকারি বিক্রেতারা চাহিদা অনুসারে আলুর সরবরাহ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে এ বছর অক্টোবর মাসে অতিবৃষ্টির কারণে আলুর বীজ রোপণে দেরি করেছেন কৃষকেরা। এতে বাজারে আগাম আলু আসতে দেরি হচ্ছে। এসব কারণে আলুর দাম বাড়ছে।
যেকোন পণ্যের দাম নির্ভের করে তার উৎপাদন ও সরবরাহের প্রকৃত তথ্য। আলু উৎপাদনের সরকারি-বেসরকারি তথ্যে গরমিল রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। চলতি বছর আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ টন। তবে হিমাগার মালিকদের দাবি ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, এ বছর আলু উৎপাদন হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার তুলনায় ১০-১৫ লাখ টন আলুর ঘাটতি রয়েছে।
একদিকে বাজারে আলুর দাম বেশি। অন্যদিকে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বীজ আলু। যদি এমন অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে সামনের মৌসুমে শুরু থেকে নতুন আলুর দাম ব্যাপক হারে বাড়তে থাকবে। এর ফলে বিপাকে পড়বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের পাশাপাশি কৃষকরাও। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবর শেষে দেশে বীজ আলুর মজুত ছিল ৫.৬৭ লাখ টন। আর বীজ আলুর চাহিদা ছিল ৭.৫ লাখ টন। অর্থাৎ ইতিমধ্যেই প্রায় ২ লাখ টন বীজ আলুর মজুত খাওয়ার আলু হিসেবে ব্যবহার হয়ে গেছে। এর ফলে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছেন আলু চাষীরা।
এক সময় জাতীয় ম্লোগান হয়ে উঠেছিল 'বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপরে চাপ কমান'। কারণ, বাংলাদেশে আলুর চাষ হয় বেশি, ফলন হয় বেশি, ফলে আলুর দাম কমে যায় একেবারে। তখন চাষীরা রাস্তায় আলু ফেলে দেন। সেই আলু এখন দামের দিক দিয়ে ভাতকে অতিক্রম করছে। আলু এবং ভাত – কোনটার ওপর চাপ কমাতে কোনটা কম খেতে হবে সেই হিসেব মিলানো যাচ্ছে না।
লেখক: সাংবাদিক