নোবেল পেলেও নিতে পারেননি পুরস্কার: মাচাদো ছাড়াও কারা বাদ পড়েছিলেন
নোবেল বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এবং স্বীকৃতি। বিজ্ঞানে আবিষ্কার, সাহিত্যে সৃজনশীলতা কিংবা শান্তির জন্য সংগ্রাম-মানবতার ইতিহাসে অনন্য অবদান রাখা মানুষদের জন্য এটি এক স্বপ্নের স্বীকৃতি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইতিহাসে এমন অনেক নোবেল বিজয়ী রয়েছেন যারা এই বিরল সম্মাননা নিজের হাতে তুলে নিতে পারেননি। কেউ স্বেচ্ছায় প্রত্যাখ্যান করেছেন, কেউ রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, আবার কেউ ছিলেন গৃহবন্দি বা কারাবন্দি।
সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী মারিয়া কোরিয়া মাচাদো যিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে বুধবার (১০ ডিসেম্বর) নরওয়ের অসলোতে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে হাজির হতে পারেননি। তবে এই তালিকায় তিনি একমাত্র নন। ইতিহাসজুড়ে এমন বহু আলোচিত নাম রয়েছেন।
যারা স্বেচ্ছায় নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ফরাসি দার্শনিক ও সাহিত্যিক জ্যঁ পল সার্ত্রে। তিনি ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পান। কিন্তু তিনি নিজে এই পুরস্কার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তার যুক্তি ছিল আদর্শগত তাই তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পদক গ্রহণ করতেন না। সার্ত্রের মতে, নোবেল পুরস্কার ছিল 'বুর্জোয়া' বা ধনিক শ্রেণির স্বীকৃতি, যা একজন স্বাধীন চিন্তাবিদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
১৯৭৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার যৌথভাবে পান যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি কিসিঞ্জার এবং ভিয়েতনামের কূটনীতিক লে দুক থো। ভিয়েতনাম যুদ্ধ অবসানে তাদের ভূমিকাই ছিল এই স্বীকৃতির কারণ। তবে লে দুক থো পুরস্কার গ্রহণ করেননি। কারণ, তার মতে-ভিয়েতনামে তখনও প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে বাধ্যতামূলক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন রুশ সাহিত্যিক বরিস পাস্তার্নাক। তিনি ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তার 'ডক্টর জিভাগো' উপন্যাসের জন্য। প্রথমে তিনি অনন্য সম্মান গ্রহণে সম্মত হলেও সোভিয়েত সরকারের প্রবল চাপ ও হুমকির মাধ্যমে তাকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করা হয়। পরে তার বই নিজ দেশেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
কারাবন্দি ছিলেন চীনের মানবাধিকার কর্মী লিউ শিয়াওবো। তিনি ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু তিনি সে সময় চীনা সরকারের হাতে বন্দি ছিলেন। অনুষ্ঠানে তার পক্ষে কেউ উপস্থিত থাকতে পারেননি। অসলোতে শুধু একটি খালি চেয়ার রেখে তার অনুপস্থিতিকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এটি নোবেল ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী প্রতীক হয়ে আছে।
গৃহবন্দি ছিলেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চি। তিনি ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। কিন্তু সামরিক জান্তার কারণে তিনি গৃহবন্দি ছিলেন এবং অসলোতে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে অনেক বছর পর, তিনি সুযোগ পেলে নিজে নোবেল বক্তৃতা দেন।
১৯৩৭ সালে নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার একটি ডিক্রি জারি করে জার্মান নাগরিকদের নোবেল পুরস্কার গ্রহণ নিষিদ্ধ করেন। ফলে তিনজন বিজ্ঞানী এই সম্মান পেয়েও তা নিতে পারেননি। তারা হলেন রিশার্ড কুন (১৯৩৮, রসায়ন), অ্যাডলফ বুটেনান্ড (১৯৩৯, রসায়ন), গেরহার্ড ডোমাক (১৯৩৯, চিকিৎসা)।
তারা পরে মেডেল ও ডিপ্লোমা পেলেও পুরস্কারের অর্থমূল্য পাননি। ২০১৬ সালে মার্কিন সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু তিনি দীর্ঘ সময় কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি, অনুষ্ঠানে যাননি এবং বাধ্যতামূলক বক্তৃতাও দেননি। পরে কয়েক মাস পর তিনি নীরবে পুরস্কার গ্রহণ করেন। তবে এই 'নীরবতা' নোবেল ইতিহাসে বড় আলোচনার জন্ম দেয়।
এদিকে আজ বুধবার ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেত্রী ও গণতন্ত্রকামী সংগ্রামী মারিয়া কোরিনা মাচাদো নিরাপত্তাজনিত চরম ঝুঁকির কারণে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারেননি। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও আত্মগোপনে থাকার কারণেই তার চলাচল ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার হয়ে পরিবারের সদস্যরা পুরস্কার গ্রহণ করেন।
নোবেল পুরস্কার শুধু একটি সম্মান নয়-এটি এক ধরনের রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবিক ইতিহাসের দলিল। যারা এই পুরস্কার হাতে নিতে পারেননি, তাদের গল্প অনেক সময় বিজয়ীদের থেকেও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই এই অনুপস্থিতিগুলোই দেখিয়ে দেয়, বিশ্বে এখনো নিপীড়ন আছে, স্বাধীন চিন্তা এখনো বিপজ্জনক অবস্থায়, আর সত্য বলার খেসারত এখনো অনেক ভয়াবহ। নোবেল কেবল পদক নয়, অনেক সময় তা হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রতীক।
Comments