যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৭ শিশু নিহত: জাতিসংঘ
গাজা উপত্যকায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে অন্তত ৬৭ ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল—ইউনিসেফ।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র রিকার্দো পাইরিস জানান, নিহতদের মধ্যে রয়েছে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত এক নবজাতক মেয়েও। এর আগের দিন ইসরায়েলের ব্যাপক হামলায় মারা যায় আরও সাত শিশু।
পাইরিস বলেন, 'এটা একটি সম্মত যুদ্ধবিরতির মধ্যে ঘটছে। ধরনটি ভয়াবহ।' তিনি জানান, ১১ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির প্রথম পূর্ণাঙ্গ দিন থেকে এ পর্যন্ত এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তার ভাষায়, 'এগুলো সংখ্যা নয়—প্রতিটি ছিল একটি শিশু, একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন, একটি জীবন—যা সহিংসতায় হঠাৎ থেমে গেছে।'
ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ফিলিস্তিনি শিশু নিহত ও আহত হয়েছে। সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে প্রতি মাসে গড় হিসেবে ৪৭৫ ফিলিস্তিনি শিশু আজীবন পঙ্গুত্বের শিকার হয়েছে—যাদের অনেকেরই মস্তিষ্কে আঘাত, গুরুতর পোড়ার ক্ষতসহ নানা ধরনের জখম রয়েছে। সংস্থাটির ভাষায়, গাজা এখন 'আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিশু-অঙ্গহানি অঞ্চল' হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অনাহরাকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ ও খাদ্যঘাটতি শিশুদের বিশেষভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে এবং ক্ষুধাজনিত বেশ কিছু শিশুমৃত্যুও ঘটেছে।
সপ্তাহজুড়ে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। সেনাবাহিনী দাবি করেছে, খান ইউনিসে তাদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এসব হামলা চালানো হয়েছে। হামাস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, সাম্প্রতিক হামলায় অন্তত ৩২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং এটি 'বিপজ্জনক উসকানি', যা দেখায়—ইসরায়েল 'গণহত্যা পুনরায় শুরু' করতে চায়।
আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা ডাক্তারস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) জানায়, তাদের চিকিৎসক দল গাজায় বেশ কয়েকজন নারী ও শিশুকে চিকিৎসা দিয়েছে—অনেকের শরীরে গুলির আঘাত, খোলা হাড়ভাঙা এবং মাথায় গুরুতর ক্ষত দেখা গেছে। গাজা সিটির মোবাইল ক্লিনিকে কাজ করা এমএসএফ নার্স জাহের জানান, তারা এক নারীর পায়ে গুলির ক্ষত এবং নয় বছরের এক শিশুর মুখে ড্রোনের গুলিতে সৃষ্ট আঘাতের চিকিৎসা করতে হয়েছে।
গাজার আল-শিফা হাসপাতালের রোগী মোহাম্মদ মালাকা বলেন, তিনি বিস্ফোরণের আগে দুটি ক্ষেপণাস্ত্র আসার শব্দ শুনেছিলেন। পরে জ্ঞান ফিরলে দেখেন, তার বাবা ও তিন ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছেন। মালাকার ভাষায়, 'আমি চার দিকে লোকজনের চিৎকার শুনছিলাম… তাবুগুলো ছাই হয়ে গেছে, আর মানুষ পড়ে ছিল সবদিকে।'
যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও মানবিক সহায়তার ওপর ইসরায়েলের কঠোর বিধিনিষেধ গাজার মানুষের সংকট আরও গভীর করেছে। আশ্রয়হীন বহু মানুষ ঠান্ডার মধ্যে তাবুর অভাবে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। ইউনিসেফের পাইরিস বলেন, অনেক শিশু 'খোলা জায়গায় ঘুমাচ্ছে', কাঁপতে কাঁপতে দিন কাটাচ্ছে প্লাবিত ও অস্থায়ী আশ্রয়ে।
তিনি আরও বলেন, 'গাজার শিশুদের ওপর যে বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তা নির্মমভাবে স্পষ্ট: তাদের জন্য কোথাও নিরাপদ নয় এবং বিশ্বের উচিত নয় তাদের এই কষ্টকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া।' তার আহ্বান, গাজায় আরও মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাইরিস বলেন, 'ধ্বংসস্তূপের ওপর তাবুতে থাকা লক্ষাধিক শিশুর জন্য এই শীত নতুন বিপদের জন্ম দিচ্ছে—রাতে কোনো গরম নেই, নেই যথেষ্ট কম্বল, নেই উপযুক্ত সুরক্ষা।'
Comments