ক্ষুধা বিপর্যয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সতর্কবার্তা

বছরের পর বছর ধরে সংঘাত এবং জাতিগত সহিংসতার শিকার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। যুদ্ধ, অবরোধ এবং তহবিল হ্রাসের মারাত্মক সংমিশ্রণের কারণে অঞ্চলটি এখন আশঙ্কাজনক ক্ষুধা সংকটের মুখোমুখি। জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গত বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আজিব বাহারের (৩৮) ছয় মাস বয়সী ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা মার কাছে শিশুকে দেওয়ার মতো কোনো ওষুধ বা খাবার ছিল না। ছেলেটি মায়ের কোলেই মারা যায়।
বাংলাদেশের কক্সবাজারের একটি শরণার্থী শিবির থেকে বাহার বলেন, 'আমার বাচ্চারা সারা রাত ক্ষুধার জ্বালায় কেঁদেছিল। আমি ঘাস সিদ্ধ করে তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলাম।'
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমারের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর একটি উচ্চ-স্তরের জাতিসংঘ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন ঘোষণা করেছে, তারা রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশি শরণার্থী শিবিরগুলোকে সহায়তা করার জন্য আরও ৯৬ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে।
ছুটিতে বেঁচে থাকা
২০২১ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্মম দমন-পীড়নের পর থেকে মিয়ানমার সংকটে রয়েছে। ফলে দেশব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয় এবং রাখাইনে জান্তা ও শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে আবারও সংঘাত শুরু হয়।
আজিব বাহার এবং তার স্বামীসহ পাঁচ জন রোহিঙ্গা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার আগে রাখাইনে গত ৬ মাস তারা শুধুমাত্র পাতা ও ঘাসের ওপর বেঁচে ছিলেন।
সাহায্য-কর্মীদের অপ্রকাশিত তথ্য অনুসারে, রাখাইনে ১ লাখেরও বেশি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশেরও কম চিকিৎসার সুযোগ পায়।
গত বছর রয়টার্স জানায়, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা গবেষকদের ক্ষুধা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ না করার জন্য এবং সাহায্য-কর্মীদের তা প্রকাশ না করার জন্য চাপ দিয়ে সংকট সম্পর্কে তথ্য দমন করেছে।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাইকেল ডানফোর্ড বলেন, 'নিরাপত্তার আশঙ্কা এবং জান্তা ও আরাকান বাহিনীর বিধিনিষেধের কারণে জাতিসংঘ জান্তা-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যের রাজধানী সিত্তে থেকে রাখাইনের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে খাদ্য পরিবহন করতে পারছে না। এটি স্পষ্টতই ক্ষুধা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।'
ডানফোর্ড আরও বলেন, 'আমরা অত্যন্ত হতাশ, কারণ আমরা জানি এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের সহায়তা প্রয়োজন।'
আরাকান আর্মির মুখপাত্র খিন থু খা বলেন, 'জান্তা খাদ্য ও ওষুধসহ সাহায্যের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।' এ অবস্থায় তারা (আরাকান আর্মি) জাতিসংঘ এবং সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করছে।
খিন বলেন, 'সংঘাতের কারণে চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু আরাকান আর্মি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যতটা সম্ভব কম রাখার এবং কর কমানোর চেষ্টা করছে।'
তাদের তথ্য অনুসারে, প্রতি চার জন শিশুর মধ্যে একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। দুর্ভিক্ষের মাত্রা এখনো কমেনি।
সাহায্য বন্ধ
সংঘাত, প্রায় ফাঁকা বাজার, স্থবির অর্থনীতি এবং অবরোধের মিশ্রণ রাখাইনের জনসংখ্যাকে আগের তুলনায় এতটা চাপে ফেলেছে, যা কখনো দেখা যায়নি।
বিশেষ করে রাজ্যের হাজার হাজার অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের ক্যাম্পগুলোতে পরিস্থিতি ভয়াবহ। যারা রোহিঙ্গা এবং পূর্ববর্তী সহিংসতার সময় তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাদের চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধের সম্মুখীন হয়েছে।
সাহায্য কর্মীদের তথ্য অনুসারে, ক্যাম্পগুলোতে অপুষ্টি ব্যাপক হারে আগে থেকেই ছিল। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের মুখে খাবার দিতে নিজেরা অনাহারে দিন কাটান। ২০২৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়ে পরিস্থিতি প্রায় দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ডানফোর্ড দুঃখ করে বলেন, 'এক ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে, যদি ডব্লিউএফপি তাদের খাওয়াতে না পারে এবং কর্তৃপক্ষ তাদের সমর্থন না করে, তাহলে তাদের ওপর যেন বোমা ফেলে এই দুর্দশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।'
গত মাসে শরণার্থী শিবিরে কর্মরত রেসকিউ কমিটি জানায়, রোহিঙ্গারা আগের শরণার্থীদের তুলনায় অনেক খারাপ স্বাস্থ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসছে। বিশেষ করে শিশু এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের মধ্যে অপুষ্টির হার বেশি।
আইআরসি বলছে, অধিক রোহিঙ্গা আগমন বিশ্বব্যাপী সাহায্য তহবিলের তীব্র ঘাটতি এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিষেবার অতিরিক্ত চাপের কারণ।
Comments