অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট ঘোষণা সোমবার

আগামীকাল অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের অর্থনীতিতে কয়েক বছর ধরেই মন্দা চলছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এরপরও অর্থনীতির কোনো সূত্র না মেনেই প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়িয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্যও রেকর্ড ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। ঘোষিত সে বাজেট বাস্তবায়ন শুরুর এক মাস পরই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারায় শেখ হাসিনা সরকার। অলীক ও অবাস্তবায়নযোগ্য সে বাজেটই টেনে নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। মাঝপথে সংশোধন করে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। যদিও সংশোধিত এ বাজেটও বাস্তবায়ন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কেননা অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ঠেকেছে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকায়।
রাজস্ব আহরণের নাজুক পরিস্থিতির মধ্যেই আগামীকাল ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এদিন বিকাল ৪টায় বাজেট ঘোষণা করবেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতার পাশাপাশি বর্তমানে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগেও খরা চলছে। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থায় রাজস্ব কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতেও এনবিআরকে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এনবিআর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দেয়া বাজেটের মতোই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিয়ে এ ঘাটতি পূরণ করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
শেখ হাসিনার গড়ে তোলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় অনেক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। উন্নয়নের কথা বলে ঋণনির্ভর সেসব প্রকল্প নেয়া হলেও এক্ষেত্রে লুটপাটই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বলে অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা শ্বেতপত্রে তুলে ধরা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আগামী বাজেটে এডিপি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দও ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে পরিচালন ও নন-এডিপি খাতে। চলতি বাজেটে এ খাতে ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে ৫ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়।
রাষ্ট্রের নাগরিকদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা, মৌলিক সেবার নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সর্বোপরি বৈষম্য প্রশমনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণীত বাজেটগুলো পরিচিত জনকল্যাণমুখী বাজেট হিসেবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ বহু বছর ধরে জনকল্যাণমুখী বাজেটবঞ্চিত হয়ে আসছে। এতদিন বাজেট মানেই ছিল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে জনগণের অর্থের যথেচ্ছ তছরুপ। আর পরিচালন ব্যয়ের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের অপব্যয় ও দুর্নীতি। অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে সুযোগ ছিল জনকল্যাণমুখী বাজেট দিয়ে জনগণকে স্বস্তি দেয়ার; দেশী-বিদেশী ঋণনির্ভর ঘাটতি বাজেট থেকে বেরিয়ে আসার; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে বৈষম্য কমিয়ে আনার। কিন্তু এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে স্বস্তির কোনো আভাস মেলেনি। রাজনৈতিক কোনো চাপ না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার জনতুষ্টির বাজেটের দিকেই হাঁটছে।
গত দেড় দশকজুড়ে ঘোষিত বাজেট ছিল অনেকটাই ঋণনির্ভর। প্রতিবারই আকার বাড়িয়ে বাজেট ঘোষণা করা হলেও কোনো অর্থবছরেই তার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাজেট বাস্তবায়নের গড় হার ছিল ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুতে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, বছর শেষে এর ১৪-১৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। পরে এ অবাস্তবায়িত বাজেটের অংশ আরো বড় হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করায় সরকারের ঋণের বোঝা কেবলই স্ফীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন সরকারের ঋণ স্থিতি মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ছিল। সে হিসাবে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। সরকারের নেয়া এ ঋণের সুদ পরিশোধেই চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৯৬ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৮১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার সুদ পরিশোধ হয়েছে দেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতে। বাকি ১৪ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকার সুদ বিদেশী ঋণের জন্য পরিশোধ করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাজেটের আকার দ্বিগুণ-তিন গুণ হলেও আনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমেছে জনগুরুত্বপূর্ণ খাত স্বাস্থ্য ও শিক্ষায়।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ। ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশের কাছাকাছি। অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এসব গণদ্রব্যের দাম কমানোর সুযোগ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। অথচ বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি তেল ও পানির মতো গণদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ চলছে আগের পদ্ধতিতেই।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা দেশের সাধারণ মানুষ। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও একই নীতি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে নীতি সুদহার উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশে। যদিও এখন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি।
Comments