ঐকের বার্তা, সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক উৎসবে মুখরিত চাঁদপুর

বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গোৎসব মানেই আনন্দ, উৎসব আর ধর্মীয় সম্প্রীতির এক মহামিলন। সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটে বিজয়া দশমীর দিনে। এ দিন মা দুর্গার বিদায় বেলায় একদিকে যেমন থাকে বেদনার আবহ, অন্যদিকে থাকে নতুন আশার আলো। এবারের বিজয়া দশমীতে চাঁদপুর জেলাজুড়ে নানা আয়োজন করেছে জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, যুব ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।
দশমীর সকালে থেকেই চাঁদপুর শহর এবং হাইমচরসহ বিভিন্ন উপজেলার পূজা মণ্ডপগুলোতে ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে। দেবী দুর্গাকে বিদায় জানাতে হাজারো নারী-পুরুষ এসে উপস্থিত হন। ঢাক-ঢোল, উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। মা দুর্গাকে বিদায় জানানোর সেই বেদনাবিধুর মুহূর্তে চোখ ভিজে ওঠে অনেক ভক্তের।
এক পূজারী আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, "দশদিনের এই আনন্দ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তবে আমরা বিশ্বাস করি, আগামী বছর তিনি আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।"
চাঁদপুর জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও যুব ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিশাল শোভাযাত্রা বের হয়। শোভাযাত্রায় অংশ নেন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাজার হাজার ভক্ত। রঙিন ব্যানার, ফেস্টুন, আবৃত্তি ও গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শোভাযাত্রাটি ছিল একেবারেই উৎসবমুখর।
চাঁদপুর জেলা যুব ঐক্য পরিষদের আহবায়ক অশরেশ দত্ত বলেন, "বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এখানে সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। বিজয়া দশমীর এই শোভাযাত্রা আমাদের সেই বার্তাই মনে করিয়ে দেয়।"
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলেন, "আমাদের মূল শক্তি হলো ঐক্য। যারা ধর্মীয় সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।" তাঁরা আরও বলেন, "দুর্গোৎসব কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, এটি বাংলার সামগ্রিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এখানে মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—সবাই সমানভাবে অংশ নেয়। এই ঐতিহ্য ধরে রাখাই আমাদের দায়িত্ব।"
যুব ঐক্য পরিষদের চাঁদপুর জেলার সদস্য সচিব পার্থসারথি দাস বলেন, তরুণ প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে। পূজা মণ্ডপে শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়েছে। তরুণরা সেখানে আবৃত্তি, নাচ, গান ও নাটক পরিবেশন করেছে। একজন যুবনেতা বলেন, "আমরা চাই তরুণরা যেন ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একসাথে কাজ করে। বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে তরুণদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।"
বিজয়া দশমীর আয়োজনে নারী ভক্তদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। সিঁদুর খেলার মধ্য দিয়ে নারীরা দেবীকে বিদায় জানান। লাল সিঁদুর মেখে তাঁরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। নারীরা বলেন, এই উৎসব তাদের কাছে আনন্দ, সৌন্দর্য এবং শক্তির প্রতীক। গৃহবধূ কাকলি রানী বলেন, "দশমীর দিন আমাদের কাছে শুধু বিদায় নয়, আবার নতুন করে শুরু করার অনুপ্রেরণা।"
বিজয়া দশমীর প্রধান শোভাযাত্রা ও অনুষ্ঠানে অংশ নেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁরা পূজারী ও ভক্তদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
সমাজসেবক শ্যামল সরকার বলেন, "বাংলাদেশ সব ধর্মের মানুষের। আমরা চাই সবাই একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়াক। পূজা-পার্বণ হোক মানুষের মিলনমেলা।"
চাঁদপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে মূল মঞ্চে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় গান, নৃত্য ও নাটিকা। স্থানীয় শিল্পীরা ছাড়াও ঢাকাসহ অন্যান্য স্থান থেকে আগত শিল্পীরা এতে অংশ নেন। দেবীর বিদায় উপলক্ষে পরিবেশিত হয় ভক্তিমূলক সংগীত।
শিল্পী বিউটি মল্লিক বলেন, "এই মঞ্চে গান গাওয়া আমাদের জন্য গর্বের। এখানে সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে—এটাই বাংলাদেশের সৌন্দর্য।"
বিজয়া দশমী উপলক্ষে শহরজুড়ে ছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবকরা একসঙ্গে কাজ করেন যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমও রাখা হয়েছিল।
পুলিশ সুপার মোঃ আব্দুর রকিব জানান, "চাঁদপুরের মানুষ শান্তিপ্রিয়। আমরা চাই উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হোক। এজন্য সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।" দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে চাঁদপুরের অর্থনীতিতেও গতি সঞ্চার হয়েছে। বাজারে বেড়েছে পোশাক, প্রসাধনী ও খাদ্যপণ্যের বিক্রি। মিষ্টির দোকানগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, পূজা-পার্বণ তাঁদের জন্য আশীর্বাদের সমান।
দোকানদার অজিত সাহা জানান, "বছরের অন্য সময়ে বিক্রি যেমন থাকে না, পূজা এলে আমাদের ব্যবসা জমজমাট হয়।"
বিজয়া দশমীর দিন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বক্তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণতান্ত্রিক অধিকার ও সামাজিক উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেন।
সভাপতি এডভোকেট বিনয় ভূষণ মজুমদার এর বক্তব্যে উঠে আসে, "আজকের দিনে সবচেয়ে প্রয়োজন ঐক্য। ধর্ম নিয়ে বিভাজন সৃষ্টি করতে যারা চায়, তাদের মোকাবিলা করতে হবে সবাইকে। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রতিটি মানুষকে মানবতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে।"
স্থানীয় শিবু, মিশু, জয় বলেন, দুর্গোৎসব তাদের জীবনে অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। মুসলিম প্রতিবেশীরাও এ উৎসবে সহযোগিতা করে। অনেকে বলেন, পূজা এখন শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
মুসলিম তরুণ ওমর ফারুক বলেন, "আমরা প্রতিবছর পূজা দেখতে যাই। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করি। পূজা আমাদের কাছে মিলনমেলা।"
চাঁদপুরের বিজয়া দশমীর এ আয়োজন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এক মহা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ও যুব ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এই উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে একত্র করেছে।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি এবং সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে এই দিনটি হয়ে উঠেছে চাঁদপুরের জন্য বিশেষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এমন আয়োজন কেবল ধর্মীয় সম্প্রীতি নয়, বরং বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রতীক।
বিজয়া দশমীর সেই বেদনা ও আনন্দমিশ্রিত আবহে তাই একটি কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে—
"ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।"
Comments