চাঁদপুরে মা ইলিশ রক্ষায় সচেতনতা অভিযান সফল করতে — মাঠে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন
"মা ইলিশ রক্ষা করলেই দেশ বাঁচবে, জেলে বাঁচবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচবে"—এই মূল বার্তা নিয়ে মাঠে নামলেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। আগামী ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান ২০২৫, যা চলবে টানা ২২ দিন — ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এই সময়ে ইলিশ আহরণ, বিক্রয় ও পরিবহন সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে।
এই উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে জেলা প্রশাসক স্বয়ং অংশ নিয়েছেন চাঁদপুর সদর ও হাইমচর উপজেলার নদী তীরবর্তী জেলে পল্লী, মাছের আড়ৎ, বাজার ও ঘাট এলাকায় পথসভায়। তার সঙ্গে ছিলেন মৎস্য বিভাগ, কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। মাঠে সরব প্রশাসন, বার্তা স্পষ্ট — মা ইলিশ বাঁচলে ইলিশ থাকবে
চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মা-বড়স্টেশন এলাকার আড়ৎগুলো, হাইমচরের আলগী, চরভৈরবী ও রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের নদীঘেঁষা জেলে পল্লী — সবখানেই সরব উপস্থিতি প্রশাসনের। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন নিজ হাতে জেলেদের মাঝে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করেছেন। পাশাপাশি কথা বলেছেন তাদের জীবনের বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়েও।
পথসভায় তিনি বলেন, "মা ইলিশ এখন ডিম ছাড়ার মৌসুমে। এই সময়ে যদি আমরা ধৈর্য ধরে মাছ ধরা বন্ধ রাখি, তাহলে আগামীতে মাছের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যাবে। শুধু জেলেই নয়, দেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে।"
লিফলেট, মাইকিং, উঠান বৈঠক — জনসচেতনতা বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে একযোগে মাইকিং, ব্যানার, পোস্টার লাগানো, লিফলেট বিতরণ এবং উঠান বৈঠক।
মৎস বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিদিন নদী তীরবর্তী গ্রামে গ্রামে চলছে সচেতনতামূলক কার্যক্রম। জেলেদের বোঝানো হচ্ছে কেন মা ইলিশ ধরা এই সময়ে মারাত্মক ক্ষতিকর। তুলে ধরা হচ্ছে আইনি দিক, জরিমানা এবং জেল হওয়ার সম্ভাবনার কথাও। তবে শুধুই আইন প্রয়োগ নয়, এবার মূল ফোকাস সংলাপ ও সহানুভূতিশীল সচেতনতা।
প্রশাসকের কথা, "জেলেদের বিকল্প আয়ের পথ খোলা থাকবে" জেলেদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ — ২২ দিন মাছ ধরতে না পারলে পরিবার চালাবে কীভাবে?
এই প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক জানালেন, "সরকারিভাবে বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম থাকবে। যেসব জেলে সত্যিকারের মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল, তাদের তালিকা করে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। পাশাপাশি বিকল্প আয়ের সুযোগ নিয়েও কাজ হচ্ছে — হাঁস-মুরগি পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা বা নৌপর্যটন।" আইন অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা, সতর্ক করলেন জেলা প্রশাসক
মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম সফল করতে শুধু সচেতনতা নয়, এবার আইন প্রয়োগেও রয়েছে কঠোর বার্তা।
জেলা প্রশাসক স্পষ্ট বলেন,
"কোনো জেলে যদি নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরার চেষ্টা করেন, তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারাদণ্ড, জরিমানা — যা আইন অনুযায়ী প্রয়োজন।"
প্রশাসনের এই বার্তা পৌঁছে গেছে প্রতিটি জেলে ঘরে ঘরে। পুলিশ ও কোস্টগার্ডও প্রস্তুত — নদীপথে টহল জোরদার করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
জেলেদের প্রতিক্রিয়া: "সরকার পাশে থাকলে আমরা আইন মানতে রাজি" চাঁদপুর সদর উপজেলার জেলে পল্লীর মো. সোহাগ বলেন,
"আমরা তো জানি মা ইলিশ ধরা ঠিক না। কিন্তু খাওয়া-পরার চিন্তায় বাধ্য হয়ে নদীতে নামতে হয়। এবার যদি সরকার ঠিকমতো চাল-ডাল দেয়, তাহলে আমরা নিজেরাই মাছ ধরা বন্ধ রাখব।"
আরেক জেলে জয়নাল জানান,
"প্রশাসন যে আমাদের কাছে এসেছে, কথা বলেছে, সেটা আগে কল্পনাও করিনি। এবার একটু সাহস পাচ্ছি। আশাকরি খাবারের ব্যবস্থা হবে।"
মৎস্য বিভাগের বার্তা: ইলিশ রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা হতে পারে
হাইমচর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার এবিএম আশরাফুল হক বলেন,
"ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ, এটি শুধু খাবার নয় — একটি রপ্তানি পণ্য। সঠিকভাবে মা ইলিশ সংরক্ষণ করলে আমরা আগামী ৫ বছরে বিশ্ব বাজারে ইলিশ রপ্তানিতে শীর্ষস্থান নিতে পারি।"
তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের অভিযানে জেলেদের সহযোগিতায় ব্যাপক সুফল পাওয়া গেছে। নদীতে ইলিশের সংখ্যা বেড়েছে, ওজনেও উন্নতি হয়েছে। এবার যদি একইভাবে অভিযান সফল হয়, তাহলে চাঁদপুর আবার 'ইলিশের রাজধানী' হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করতে পারবে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), ইউএনও, জনপ্রতিনিধিরাও সক্রিয়
জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি মাঠে দেখা গেছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও), ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। তারা নিজেরাও অংশ নিয়েছেন উঠান বৈঠকে, কথা বলেছেন জেলে পরিবারগুলোর সঙ্গে।
হাইমচর উপজেলার ইউএনও অমিত রায় বলেন,
"কোনো জেলেকে যেন না খেয়ে থাকতে না হয়, তা নিশ্চিত করা হবে। পাশাপাশি যারা আইন ভঙ্গ করবে, তাদের শাস্তির মুখোমুখিও হতে হবে। এই দুটো দিকেই নজর থাকবে।"
সচেতনতা, সহমর্মিতা আর শৃঙ্খলায় এগিয়ে চলছে মা ইলিশ অভিযান
চাঁদপুর জেলায় মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শুধুই একটি প্রশাসনিক কার্যক্রম নয় — এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, মৎস্য বিভাগ ও জেলে সম্প্রদায়ের যৌথ চেষ্টায় এবার 'মা ইলিশ রক্ষা' শুধু স্লোগান নয়, বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে কার্যকর উদ্যোগে রূপ নিচ্ছে।
এখন দেখার বিষয়, ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে যা দেখা গেছে — চাঁদপুর প্রস্তুত, জেলেরা প্রস্তুত — শুধু প্রয়োজন সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন।
Comments