শৃঙ্খলা ফিরছে না টাঙ্গুয়ার হাওরে, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য

হাওরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শতশত হাউসবোট ও ইঞ্জিনচালিত ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা। মানা হচ্ছে না কোন নিয়মনীতি। এ-সব হাউসবোট টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ-টাওয়ার সংলগ্ন এলাকায় হিজল-করচ গাছে কিংবা গাছের ঢালে বেঁধে রাখা হয়৷ আর এ কারণে ভাঙ্গছে গাছের ডাল-পালা। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর৷ এখানকার নীল জল, আকাশে সাদা মেঘ ও সবুজ হিজল-করচ গাছের সারি যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করে তোলে। বর্ষায় নৌকাভ্রমণের সময় চারপাশের গ্রামগুলোর সাধারণ জীবনযাত্রা ও হাওরের সৌন্দর্য এক নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয় পর্যটকদের। কিন্তু হাওরে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনে দিনদিন বাড়ছে ঝুঁকি।

শুক্রবার ও শনিবার (২২ ও ২৩ আগস্ট) দুইদিন টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (শুক্রবার) অন্তত শতাধিক হাউসবোট প্রবেশ করছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ হাউসবোট হাওরের সারিবদ্ধ হিজল-করচ গাছের সাথে বেঁধে রাখতে দেখা যায়। অনেকসময় বাতাসে হাওরে ঢেউ উঠলে সেই ঢেউয়ের কারণে গাছের সাথে হাউসবোটের ধাক্কা লাগে, আর এতে ভাঙ্গছে গাছের ডাল-পালা।
বজরা, হাওরের সুলতান, জলের গান , গলুই, জল প্রসাদ, ফ্যান্টাসিক টাঙ্গুয়া, হাড্ডি কুলুস, জল পদ্ম, The Captain, জ্যোৎস্নার গল্প, ওয়াটার নেস্টসহ অন্তত ৫০টি হাউসবোট ঘুরে দেখা গেছে, হাউসবোট গুলোতে লাইফ জ্যাকেট, বয়া, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইশার) ছাড়া কিছুই নেই। আবার অনেক হাউসবোটে কেবল নামমাত্র কিছু লাইফ জ্যাকেট রাখা হয়, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। তবে, স্থানীয় ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত নৌযানে কোনো ধরনের নিরাপত্তা সামগ্রী নেই বললেই চলে। এছাড়া, প্রাথমিক চিকিৎসার কিট থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ হাউসবোট ও স্থানীয় নৌকায় এগুলোর উপস্থিতি নেই। এমনকি, জরুরি পরিস্থিতিতে যাত্রীদের নিরাপদ রাখার জন্য প্রশিক্ষিত কোনো কর্মীও নেই। আবার, অধিকাংশ হাউসবোটে ছাদে বা জানালার পাশে কোনো ধরনের সুরক্ষা রেলিং (Rolling) নেই, যা হাওরে আসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অভিযোগ, এসব হাউসবোটে নেই সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা নিরাপদ সেফটি ট্যাংক। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মানববর্জ্য সরাসরি হাওরের পানিতে মিশে যাচ্ছে, যা জলজ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। এতে করে একদিকে যেমন পানির গুণগত মান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি হাওরের জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। কর্তৃপক্ষের নজরদারি এবং তদারকির অভাবে হাউসবোট মালিকরা পরিবেশের এই ক্ষতি অবাধে চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি এসব হাউসবোটের নেই রেজিষ্ট্রেশনও৷

এদিকে, হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে এখানকার আশপাশের গ্রামের মানুষজন৷ দিনদিন হাওরের পানি দূষিত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা। স্থানীয় জেলে রবিন মিয়া বলেন, 'আগে আমরা যে পরিমাণ মাছ পেতাম, এখন তার ১০ ভাগও পাই না। পানি নোংরা হওয়ায় মাছের রোগ হচ্ছে, অনেক মাছ মরেও যাচ্ছে। মাছ একেবারে নেই বললেই চলে। শুধু মাছ নয়, হাওরের পানি ব্যবহারকারী স্থানীয় মানুষজনও বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন৷ শীঘ্রই এই বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। '
সংকটাপন্ন এই হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদের সচেতনতার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। যেখানে পর্যটকদের জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার, লাইফ জ্যাকেট পরিধান, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হতে বিরত থাকা, দূর থেকে পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ করা, ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তুলা, স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ, ক্যাম্পফায়ার বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

এছাড়াও কিছু বিষয় বর্জন করতে বলা হয়েছে। সেগুলো হলো, উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা/শোনা যাবে না। হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না। মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ করা যাবে না। পাখিদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে কোন ধরণের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না। ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু বা রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। গাছ কাটা, গাছের ডাল ভাঙ্গা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না। কোর জোন বা সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না। মনুষ্য সৃষ্ট জৈব বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না।
কিন্তু এইসব নিয়মনীতি যেন কাগজে কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করতে নিষেধ করা হলেও অবাধে প্রতিদিন প্রবেশ করছে অন্তত ২ শত ছোট-বড়, মাঝারি সাইজের নৌকা। আবার কখনো কখনো ওয়াচ-টাওয়ারের নিকটবর্তী এলাকায় হাউসবোট প্রবেশ করছে। নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা আছে, হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না। কিন্তু প্রতিনিয়তই হাওরে প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলেছেন পর্যটকরা৷ আর, হাওরের পানিতে গোসল করতে নেমে শ্যাম্পু ব্যবহার করছেন না, এই দৃশ্য খুবই কম চোখে পড়বে। হাউসবোট ও ছোট বউ নৌকা গুলো গাছের সাথে বেঁধে ভাঙ্গা হচ্ছে হিজল করচ গাছের ডাল-পালা। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় স্থানীয়রা গাছ ও গাছের ডাল কেটে তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন। মাছ ধরা নিষেধ থাকলেও কারেন্ট জাল, খাঁড়া জাল, ভাসা জাল, প্লাস্টিকের চাঁই, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামসহ নানান ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ শিকার করা হচ্ছে। যা হাওরের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। এদিকে, হাওরে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা বা শোনা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া থাকলেও তা কখনোই মানছেন না পর্যটকরা৷ শুক্রবার দুপুরেও একদল তরুণদের ওয়াচ-টাওয়ার সংলগ্ন স্থানে ছোট একটি ইঞ্জিন চালিত নৌযানে ঢাক-ঢোল, গিটার বাজিয়ে উচ্চ শব্দে গান গাইতে দেখা যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওর একসময় দেশের অন্যতম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অঞ্চল ছিল। হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি, জলের ওপর ভেসে থাকা হিজল-করচ গাছ, দেশী-বিদেশী পাখির ওড়াউড়ি; পাশেই খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়- সব মিলিয়ে এই হাওর ছিলো প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্টি এক কুমারী জলকন্যা। এখন হাওরের সে রূপ-যৌবন আর কোনোটাই নেই বললেই চলে। তবুও সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে টাঙ্গুয়ায় পর্যটক সমাগম আরও বেড়েছে। যত সময় যাচ্ছে, হাওর পর্যটনের নামে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ততই বাড়ছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। পর্যটকদের অনেকের চলাফেরা, আচার-আচরণ স্থানীয় মানুষদের চিরায়ত রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক পর্যটকের চাপ এবং বেশিরভাগ পর্যটকের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি উদাসীনতার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে সংরক্ষিত এই জলাভূমি।

বর্ষাকালে সারা দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের নৌকা ও হাউসবোট এসে ভিড় করে সুনামগঞ্জের সাহেব বাড়ি ঘাট, তাহিরপুরের আনোয়ারপুর ঘাট, তাহিরপুর বাজার ঘাটে৷ সেখান থেকে পর্যটকরা নৌকা ও হাউসবোট ভাড়া করে টাঙ্গুয়ার হাওর ও হাওরপাড়ের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণ করেন। আবার অনেকেই রাতে নৌকাতেই রাত্রিযাপন করেন। পর্যটকরা নৌকা ভাড়া করে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা টাঙ্গুয়ার হাওরের ভেতরে গিয়ে সাউন্ড বক্স দিয়ে গান-বাজনা করেন। খাবারের প্লাস্টিক প্যাকেট ফেলে দেন হাওরের পানিতে। পর্যটকবাহী ইঞ্জিন নৌকার কারণেও দূষিত হয় হাওরের পরিবেশ। পর্যটকদের চাপ বাড়ার কারণে হাওরে কমেছে দেশীয় মাছ, কমেছে হাওরে পাখির সংখ্যা। তবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কমছে বলে দাবি হাউসবোট ও নৌকার ব্যবস্থাপকদের৷
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট–বড় ১০৯টি বিল আছে। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' ঘোষণা করে সরকার। এতে ইজারাদারির অবসান হয়। এরপর ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি 'রামসার সাইট' বা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হাওরের জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় হাওরটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসন টাঙ্গুয়ার হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় শুধুমাত্র প্রশাসন একা কাজ করে কিছুই করতে পারবে না৷ প্রশাসনকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। সবাই মিলে কাজ করলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। একই সাথে হাওরে আসা পর্যটকদের সচেতন থাকতে হবে। পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না৷ এই টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সম্পদ, এটি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান মানিক বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। আমি কিছুদিন হয় দায়িত্ব নিয়েছি, শীঘ্রই হাওরের এসব বিষয়ে খুঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নিবো৷
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস মিয়া বলেছেন, 'টাঙ্গুয়ার হাওর দেশের সম্পদ। তাই হাওরে এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে প্রকৃতি, পরিবেশ ও হাওরের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। এটি আমরা হতে দেব না। এ জন্য সবার সচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন৷
Comments