বর্ষা মৌসুমে জমে উঠেছে জলের বাহন 'ডোঙার' হাট

নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর বাজার ডোঙা বেচাকেনার এই অনন্য গ্রামীণ হাটের দেখা মেলে এ বাজারে। এ বাজারে একটি বৃহৎ রেইন্ট্রি গাছের নিচে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার বসে এই হাট। ভোর থেকে শুরু হয়ে হাট চলে দুপুর পর্যন্ত। ডোঙা বেচাকেনার এই হাট বসে শুধু বর্ষা মৌসুমেই।
ভোরের আলো ফুটতেই একে একে 'ডোঙা' নিয়ে হাজির হন কারিগররা। গাড়ি থেকে নামিয়ে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় ডোঙাগুলো। কারিগরদের কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন শেষ মুহূর্তের আঁচড় দিয়ে ডোঙাগুলোকে নিখুঁত রূপ দিতে। বেলা বাড়তে না বাড়তেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ক্রেতারা। কেউ যাচ্ছেন ঘুরে ঘুরে পছন্দের ডোঙা খুঁজে নিতে, কেউ আবার দরদাম নিয়ে জড়িয়ে পড়ছেন বিক্রেতার সঙ্গে তর্কে। এভাবেই ধীরে ধীরে জমে ওঠে হাট।
তালগাছ কেটে বানানো হয় বলে এটি 'তালের ডোঙা' নামেও পরিচিত। ডোঙা মূলত ডিঙি নৌকার চেয়ে ছোট, লম্বাটে এক ধরনের জলের বাহন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই হাটে ডোঙা তৈরি করেন নড়াইল সদর উপজেলার চর-শালিখা গ্রামের কারিগররা। এসব ডোঙা বিক্রি করেন তুলারামপুরের হাটে।
একটি তালগাছ থেকে দুটি করে ডোঙা তৈরি করা যায়। গাছ কাটা থেকে শুরু করে ডোঙা তৈরি করতে চারজন কারিগরের একদিন সময় লাগে। ডোঙা তৈরিতে প্রয়োজন হয় বয়স্ক তালগাছের। আর মূলত সার আছে কি না, তার ওপর ভিত্তি করেই ডোঙার দাম ওঠানামা করে। সার আছে এমন তালগাছের দাম অসার গাছের তুলনায় বেশি হয়। অসার তালগাছের দাম কম, তাই সেই গাছের ডোঙার দামও কম হয়। এছাড়া ডোঙার আকৃতির ওপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয় দাম।
স্রোতহীন, কম গভীর জলে পারাপার, মাছ ধরা, শাপলা তোলা, ধান-পাট কাটা, শামুক সংগ্রহ-এসব কাজে স্থানীয়দের সহজ ও সুলভ বাহন এই তালের ডোঙা। ফলে বৃষ্টি বেশি হলে খাল-বিল ও মুক্ত জলাশয়ে যখন পানি বাড়ে, তখন এই বাহনের ব্যবহারও বেড়ে যায়। এ বছর শুরু থেকেই ভালো বৃষ্টি হওয়ায় প্রয়োজনের তাগিদে ডোঙার হাটে ভিড় করছেন ক্রেতারা।
বাবার পেশা ধরে রাখা কারিগর নজরুল শেখ বলেন, তাল গাছের মান অনুযায়ী মালিকের কাছেরতে একেকটা ৩ থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা দিয়ে কিনি। এট্টা গাছে দুইডে ডোঙা হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে একেকটা ডোঙা ২ থেকে ৩ হাজার টাকা লাভ থাকে আমাগে। পানি বাড়ায় এ বছর ডোঙার চাহিদা ভালোই।
হাটে ডোঙা বিক্রি করতে আসা চর-শালিখা গ্রামের মো. সজীব নামে এক কারিগর বলেন, বহু আগেরতে আমাগের গ্রামের লোকজন ডোঙা বানায়। আমরা প্রায় ২৫ বছর ধইরে ডোঙা বানাচ্ছি। নিজেরা বানায়ে নিজেরাই বেঁচি। প্রথমে আমরা এলাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুইরে ঘুইরে তালগাছ কিনি। এরপর শ্রমিক ভাড়া করে সেখান থেকেই গাছ কাইটে ডোঙা বানায়। পরে তুলারামপুর হাটে আইনে বেঁচি।
সার আছে এমন ডোঙার চাহিদা বেশি জানিয়ে বিক্রেতা ইয়াদুল শেখ বলেন, সার আছে এরাম ডোঙা ৬ হাজার থেকে শুরু কইরে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এই ডোঙা ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত টেকে। আর অসার গাছ দিয়ে বানানো ডোঙা বিক্রি হয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। এরাম ডোঙা ৪ থেকে ৫ বছরের বেশিদিন টেকে না।
দীর্ঘক্ষণ ঘুরে একটি ডোঙা কিনেছেন নিরঞ্জন ঘোষাল। তিনি বলেন, আমাগের একটা মাছের ঘের আছে। ঘেরে মাছরর খাবার দেব, আর শামুক কুড়বো। এইজন্যি ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা ডোঙা কিনিছি। ঘের পর্যন্ত ডোঙা নিতি আমার আরো এক হাজার টাকা খরচ হবে।
শুধু স্থানীয় ক্রেতারা নয়, আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও পাইকাররা এই হাটে ডোঙা কিনতে আসেন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই হাট থেকে ডোঙা কিনে এলাকায় বিক্রি করেন যশোরের মনিরামপুরের আনন্দ দত্ত। গত সোমবার ডোঙা কিনতে এসেছিলেন।
তিনি বলেন, বৃষ্টির সময় হলি আমি এই ডোঙার ব্যবসা করি। এতে ভালোই লাভ হয়। একবার চার হাটের লাভের টাকা দিয়ে বাড়িতে একখান ঘর তুলিছিলাম। এই ব্যবসা করেই ছেলে-মেয়েরে পড়াশোনা করাইছি, সংসার চলতিছে। আজকে হাটে আইসে দুইডে ডোঙা কিনছি, আরও কেনবো। যতদিন মানুষ ডোঙা কেনবে, আমিও ততদিন ব্যবসা করব।
মাগুরা থেকে ডোঙা কিনতে আসা রমেশ বিশ্বাস বলেন, আমাগেরর বাড়ির একপাশে নদী আছে, আরেকপাশে বিল। ওহানতে মাছ ধরব, এইজন্যি ডোঙা কিনতে আইছি। হাট ঘুইরে ঘুইরে ডোঙা দেখতিছি, দাম একটু বেশি মনে হচ্ছে। যদি পছন্দ হয় আর দামে পটে তাহলে একখান ডোঙা কিনে নিয়ে যাব।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) নড়াইল জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক (প্রকৌশলী) মো. সোলায়মান হোসেন বলেন, এ জেলার চর-শালিখা গ্রামেই শুধু তালের ডোঙা তৈরি হয়। প্রায় শতাধিক পরিবার এ কাজে জড়িত। আদি পেশা হিসেবে তাঁরা এটি ধরে রেখেছেন। তাঁদের তৈরি ডোঙার মান অনেক ভালো। এই ডোঙা তুলারামপুর বাজারে বিক্রি হয়। সেখান থেকে যশোর, ফরিদপুর, মাগুরা, রাজবাড়ীসহ সারা বাংলাদেশে চলে যায়।
তিনি আরো বলেন, তাঁদের এই পণ্যের প্রসারের জন্য বিসিক কাজ করছে। একই সঙ্গে আর্থিক, ঋণ, প্রযুক্তি ও পণ্যের বাজারজাতকরণে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের এই পেশা যাতে টিকে থাকে, সেজন্য বিসিকের সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
Comments