যেসব কারণে দেশে দিন দিন আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছে

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে ভয়াবহ গরমে পুড়ছে খুলনাসহ আশপাশের জনপদ। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বাড়ছে তাপমাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের এ গতি অব্যাহত থাকলে সামনে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে খুলনাবাসী এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু তাপপ্রবাহ নয়, এর প্রভাবে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পানি সংকট ও জীববৈচিত্র্য বড় হুমকির মুখে পড়ছে।
পাঁচ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে ৭ ডিগ্রি!
চলতি মে মাসেই খুলনায় রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। একই সময় যশোর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরাসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দাহ্য তাপপ্রবাহ বইছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় ২০২০ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪.৪ ডিগ্রি, ২০২১ সালে ৩৬.৪, ২০২২ সালে ৩৫.২, ২০২৩ সালে ৪১.৩ এবং ২০২৪ সালে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সদ্য সাবেক আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, 'গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ অঞ্চলে প্রতি বছরই তাপমাত্রা বাড়ছে। এর মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। প্রায় প্রতি বছরই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ অঞ্চল আরও বড় বিপদের মুখে পড়বে।'
অস্বাভাবিক গরমের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব
তাপমাত্রা বৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়ছে কৃষি ও মৎস্য খাতে। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, 'তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমাদের ফসল উৎপাদনের স্বাভাবিক প্যাটার্ন পরিবর্তিত হয়েছে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রায় বোরো ধানে চিটা হচ্ছে, খরায় তরমুজসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, আমের গুটি ঝরে পড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন মাঠে পাট রয়েছে, কিন্তু উচ্চ তাপমাত্রার কারণে পাট চাষও ক্ষতির মুখে পড়ছে। তাপমাত্রা আরও বাড়লে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে। তখন আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এতে করে কৃষিজমি হারিয়ে যেতে পারে '
কেন বাড়ছে তাপমাত্রা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য কেবল বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নয়, স্থানীয় কিছু অনিয়মও দায়ী। উন্মুক্ত জলাশয় ও বনভূমির হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ন, দখল-দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন খুলনা অঞ্চলের আবহাওয়াকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল, ওয়াটার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. সানাউল ইসলাম বলেন, 'আমরা নিজেরাও সমানভাবে দায়ী। খুলনায় খাল-বিল, জলাশয় ও সবুজ জায়গা দ্রুত হারে কমছে। অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, রাস্তা ও শিল্প স্থাপন শহরকে এক রকমের গরম বাতাস জমে থাকা উত্তপ্ত চেম্বারে পরিণত করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা আগামী পাঁচ বছর অব্যাহত থাকলে এখানকার কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পানি সংকট সব কিছু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এখনই পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে কঠোর রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণের সময়।'
তার মতে, 'আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে সচেতনতা, সবুজায়ন, জলাশয় সংরক্ষণ এবং সুশৃঙ্খল নগর পরিকল্পনা ছাড়া সামনে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব নয়।'
Comments