জামায়াত-এনসিপি সম্পর্কের মেরুকরণ
ঢাকা জার্নাল বিশ্লেষণ
এনসিপি কি জামায়াতে বিলীল হয়ে গেল? ঠিক এমন একটি প্রশ্ন উঠছে। খোদ দলের ভিতর থেকেই এমন মন্তব্য করা হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে নির্বাচনী জোট গড়েছে ২০২৪ সালের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের দল এনসিপি। এর প্রতিবাদের দলের বেশ কয়েকজন নারী নেত্রী পদত্যাগ করেছেন, কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় থাকার ঘোষণা দিয়েছে। অনেক পুরুষ নেতৃত্বও পদত্যাগ করেছেন।
এনসিপি থেকে বলা হচ্ছে,এটা আদর্শিক ঐক্য নয়,নির্বাচনী সমঝেতা। কিন্তু এ কথা মানতে নারাজ দলের অনেকই। এনসিপি'র জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন,"এর জন্য এনসিপিকে কঠিন মূল্য দিতে হবে"। আরও ৩০ জন নেতা দল প্রধানকে চিঠি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে - ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে সংকটে পড়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের জোট নেওয়া নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন ও অফলাইন পরিসরে তীব্র আলোচনা চলছে। কেউ এটিকে রাজনৈতিক বাস্তবতার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে দেখছেন, কেউ আবার বলছেন এর মাধ্যমে এনসিপি তার স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তাই হারিয়ে ফেলেছে। সমর্থকরা যুক্তি দিচ্ছেন, অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয় দলই জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় গেছে, ফলে এনসিপির ক্ষেত্রে এটাকে "অস্বাভাবিক" বলা ঠিক নয়। কিন্তু এই বিতর্ক যদি কেবল "কে কার সঙ্গে ছিল" তালিকায় আটকে যায়, তাহলে মূল প্রশ্নগুলো আড়ালেই থেকে যায়।
আসল প্রশ্ন হলো-এনসিপির সামনে বাস্তবে কী বিকল্প ছিল? এবং এই জোট কি হঠাৎ নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত,নাকি বহুদিনের প্রস্তুতির ফল?
বিকল্পের সীমাবদ্ধতা
তাত্ত্বিকভাবে এনসিপির সামনে তিনটি পথ খোলা ছিল: একা চলা, বিএনপির সঙ্গে জোট, অথবা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা। কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে এই তিনটি পথ সমানভাবে খোলা ছিল না। একা চলার জন্য যে ধরনের সাংগঠনিক কাঠামো, মাঠপর্যায়ের নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার-এনসিপির তা কখনোই নিজস্বভাবে ছিল না।
বিএনপির সঙ্গে জোটের পথটি আদর্শিকভাবে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলেও, সেটি এনসিপির জন্য সাংগঠনিক আত্মঘাতী হতো। কারণ এনসিপির যে কর্মসূচী, দ্রুত গড়ে ওঠা উপজেলা-জেলা কমিটি, কিংবা বড় সমাবেশে লোকসমাগম - এর পেছনে জামায়াতে ইসলামি লজিস্টিক ও কমী জোগান দেওয়ার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বিএনপির দিকে গেলে এই সহায়তা খুব গোছানোভাবে হতো না। এই বাস্তবতায় জামায়াতের সঙ্গে জোট নেওয়াই ছিল সবচেয়ে কম ক্ষতির পথ -নৈতিকভাবে নয়, বরং সংগঠনের হিসাবে।
হঠাৎ নয়, দীর্ঘ প্রস্তুতি
এনসিপি–জামায়াত জোটকে অনেকেই আকস্মিক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শুরু থেকেই এনসিপির রাজনৈতিক অভিযাত্রা জামায়াতের সহায়তার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল ছিল। সভা-সমাবেশে লোক পাঠানো, লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া,দ্রুত থানা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন-এসবই সেই নির্ভরতার প্রমাণ।
অনেক এলাকায় এনসিপির স্থানীয় নেতৃত্ব পুরোপুরি জামায়াতপন্থী ব্যক্তিদের হাতে ছিল। কেন্দ্রীয় পর্যায়েও এমন অনেক নেতা প্রভাবশালী ছিলেন, যাঁরা অতীতে শিবির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা হয়তো নতুন প্ল্যাটফর্মে নতুন ভাষায় রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন,কিন্তু এর ফলে এনসিপির ভেতরে আদর্শগত ভারসাম্য ক্রমেই দক্ষিণপন্থী ধারার দিকে হেলে পড়ে।
এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই পার্টির ভেতরে একটি জামায়াতপন্থী ব্লক ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, আর উদারপন্থী ও মধ্যমপন্থী অংশটি প্রান্তিক হয়ে পড়ে। তা ছাড়া এনসিপির রাজনৈতিক বয়ানও ছিল জামায়াতের বয়ানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভাঙনের রাজনীতি
এই প্রেক্ষাপটেই এনসিপির ভেতর থেকে তাসনিম, তাসনোভাদের বিদায়কে দেখতে হবে। এটি কোনো ব্যক্তিগত অভিমান বা হঠাৎ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়। তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এমন একটি ধারা, যারা মুক্তিযুদ্ধ, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় এবং নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থানে বিশ্বাস করতেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন -এই পার্টির ভেতরে থেকে আর পার্টির দিকনির্দেশ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সংগঠন যেখানে আদর্শকে ছাপিয়ে যায়, সেখানে আদর্শিক রাজনীতির জায়গা সংকুচিত হয়। ফলে বেরিয়ে যাওয়াটাই তাঁদের জন্য একমাত্র সৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
নতুন মেরুকরণের সূচনা
এনসিপি-জামায়াত জোটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব সম্ভবত তাৎক্ষণিক নির্বাচনী হিসাব নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ বিন্যাস। এই জোট স্পষ্ট করে দিয়েছে যে,দেশের রাজনীতি দ্রুত দুইটি প্রবল ব্লকে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
একদিকে রয়েছে স্পষ্ট দক্ষিণপন্থী ইসলামী রাজনৈতিক ব্লক,যার নেতৃত্বে জামায়াত এবং যার সঙ্গে এখন এনসিপিও যুক্ত। অন্যদিকে রয়েছে দক্ষিণপন্থী ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে আপস না করা মধ্যমপন্থী ধারা,যার কেন্দ্রবিন্দুতে আপাতত বিএনপি অবস্থান করছে। এই দুই ব্লকের টানাপোড়েনই আগামী দিনের রাজনীতির দিক নির্ধারণ করবে।
শেষ কথা
এনসিপির জামায়াতের সঙ্গে জোট নেওয়া তাদের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, এনসিপি আর কোনো মধ্যমপন্থী,সর্বজনগ্রাহ্য রাজনৈতিক পরীক্ষানিরীক্ষা নয়। এটি এখন একটি দক্ষিণপন্থী দল।
এই জোট আদর্শের পরাজয়, নাকি সংগঠনের বাস্তব জয়, সে বিতর্ক চলবেই। তবে ইতিহাসের কাঠগড়ায় শেষ পর্যন্ত বিচার হবে এই প্রশ্নে: এনসিপি কি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি করতে পেরেছে, নাকি বড় এক "মাদার অর্গানাইজেশন"-এর ছায়াতেই তার যাত্রা থেমে যাবে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না।
Comments