প্রশ্নহীন সময়ে প্রশ্ন করার সাহস
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই সময়টায় এদেশের মানুষের জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্ত। পরাজয় বুঝতে পেরে মরণকামড় দেয় ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, যুদ্ধ শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হত্যা করে চলছিল প্রতিবাদী মেধাবী উদার ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ বুদ্ধিজীবীদের।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দিবসটি উপলক্ষে এক বাণিতে বলেছেন, জাতিকে ব্যর্থ করাই ছিল ঘাতকদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি গণতান্ত্রিক উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।
কিন্তু আমরা কি পেরেছি দেশে একটি গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতি গড়ে তুলতে? বেশিরভাগই বলবেন, পারিনি। আন্তোনিও গ্রামশি তাঁর কারাগার জীবনের নোট বইতে লিখেছিলেন, সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, এ কথা তাই বলা যায়, কিন্তু সমাজে সকলের ভূমিকা বুদ্ধিজীবীর নয়। এই উক্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক তীব্র দ্বন্দ্ব: চিন্তা করার ক্ষমতা সবার আছে,কিন্তু চিন্তার দায় কাঁধে তোলার অধিকার ও ঝুঁকি সবার নয়। প্রশ্ন তোলার সাহস, মত প্রকাশের দৃঢ়তা - এসব কেবল মেধার ফল নয়; এগুলো সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা ও নৈতিক দৃঢ়তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বুদ্ধিজীবী হলেই কি স্বাধীনভাবে কথা বলা যায়? বিশেষ করে আজকের বাংলাদেশে, যেখানে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে একটি উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী এই আশঙ্কা এখন সবার ভিতর ছায়ার মতো লেগে থাকে। দেশে স্বাধীন মত প্রকাশ একধরনের ব্যক্তিগত ঝুঁকি। অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুললে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, চরিত্রহনন, বা গোষ্ঠীচ্যুতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে স্বাধীন মত প্রকাশ ক্রমে সাহসের নয়, আত্মসংযমের পরীক্ষায় পরিণত হচ্ছে।
এই ভয়ভিত্তিক বাস্তবতায় সমাজ ক্রমশ 'আমরা-ওরা' বিভাজনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিবন্ধীকৃত গোষ্ঠীর ভেতরে ঢুকে পড়ার তাগিদে স্বাধীন চিন্তাগুলোকে আমরা নিজেরাই পানসে করে দিচ্ছি। হাততালি বা চুনকালির আশঙ্কায় নিষ্কম্প থাকা মানুষ আজ বিরল। অথচ গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাণশক্তি তো এই নিষ্কম্পতাতেই - যেখানে ভিন্নমত সহ্য করা হয়, প্রশ্নকে শত্রুতা নয়, উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়।
এ সময়ে আলোকিত, উদার বুদ্ধিজীবীতার বাইরে এক ধরনের কুংসংস্কারাচ্ছন্ন বুদ্ধিজীবিতার বিকাশ লক্ষ করা যায়, যারা ভিন্ন কণ্ঠকে কোনো জায়গা দিতে রাজি নয়। তাদের বয়ান সরল অথচ বিপজ্জনক: 'বুদ্ধিজীবীরা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর, তাঁদের থেকে দূরে থাকুন।' এই বক্তব্যে বুদ্ধিজীবীকে 'জনবিচ্ছিন্ন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যেন প্রশ্ন তোলা মানেই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান। ফলত যুক্তির জায়গায় আবেগ, আলোচনার জায়গায় ফতোয়া এবং বিতর্কের জায়গায় বর্জন বসে যায়।
যখনই বুদ্ধিজীবীরা কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করেন, তখন সামাজিক মাধ্যমে এক পরিচিত কৌশল দেখা যায় -'অমুক সময়ে তাঁরা কী করছিলেন?' এমন প্রশ্ন তুলে তাঁদের নৈতিক অবস্থানকে হেয় করা হয়। যুক্তির মোকাবিলায় যুক্তি না এনে অতীতের খোঁচা দিয়ে বর্তমান প্রশ্নকে অকার্যকর করা হয়। এতে প্রশ্নটাই হারিয়ে যায়; থাকে শুধু চরিত্রহত্যার কোলাহল। অথচ ইতিহাস বলে, বুদ্ধিজীবীর কাজ ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা নয়, বরং ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো।
বুদ্ধিজীবীরাই সমাজকে প্রশ্ন করতে শেখায়। প্রশ্নহীন সমাজ মানে স্থবির সমাজ, যেখানে আনুগত্যই একমাত্র নাগরিক গুণ। ক্ষমতা যাদের হাতে, তাদের দেখাতে হয় প্রশ্নহীন আনুগত্য; আর যারা প্রশ্ন তোলেন, তারা হয়ে ওঠেন হত্যাযোগ্য। এই অস্বস্তিই আসলে সমাজের স্বাস্থ্যচিহ্ন, কারণ প্রশ্ন না থাকলে অন্যায় স্বাভাবিক হয়ে যায়, আর ভয় হয়ে ওঠে নীতি।
নির্ভীক মনও আশেপাশের শঙ্কিত চেতনার দোলায় কখনও টাল খায়, এটাই মানবিক। তবু সমাজে থেকে যাওয়া হাতে গোনা কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষের নিঃস্বার্থ মন, তাদের বোধের ক্ষুদ্র সলতেটুকু আমাদের নাগরিক চেতনার অন্ধকারে আলো জ্বালায়। তারা হয়তো সংখ্যায় কম, আওয়াজে ক্ষীণ; তবু তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করে, চিন্তার স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নিভে যায়নি।
এই আলোকে বাঁচিয়ে রাখাই আজ আমাদের নাগরিক দায়। বুদ্ধিজীবী হওয়া মানে কেবল লেখা বা বলা নয়; বুদ্ধিজীবীতা এক নৈতিক অবস্থান, যেখানে ভয়ের চেয়ে সত্য বড়, আর গোষ্ঠীর চেয়ে মানবিকতা। প্রশ্নহীন সময়ে প্রশ্ন করার সাহসই শেষ পর্যন্ত সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর সেই সাহসের ক্ষুদ্র প্রদীপ, যতদিন জ্বলবে, ততদিন অন্ধকার চূড়ান্ত হতে পারবে না।
Comments