এক বছরে চারবার আইন সংশোধন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর চারবার আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছর ১৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এর আগে ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ আসে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রথম সংশোধনী আনা হয় গত বছর নভেম্বরে। আগে শুধু বাংলাদেশের ভেতরে সংঘটিত অপরাধকে আমলে নিতে পারতেন ট্রাইব্যুনাল। ২৪ নভেম্বর তা সংশোধন করে দেশের বাইরে থেকে সংঘটিত অপরাধও ট্রাইব্যুনালে আমলে নেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়। এরপর ভারতে বসে 'উস্কানিমূলক বক্তব্য' দেওয়ায় আদালত অবমাননার দায়ে শেখ হাসিনাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
এ সংশোধনীতে আরও কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে যে কোনো দেশের নাগরিক বাংলাদেশের ভেতরে এই আইনে উল্লিখিত অপরাধ করলে তার বিচার করা যাবে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা, যে কোনো বাহিনীর বিচার করা যাবে। আক্রমণ, নিপীড়ন, গুম, যৌনদাসী, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ও জোরপূর্বক বন্ধ্যা করা এ আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তদন্ত কর্মকর্তা যে কোনো স্থান তল্লাশি করতে পারবেন; যে কোনো নথিপত্র জব্দ করতে পারবেন। আসামিপক্ষ ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বিচারের যে কোনো পর্যায়ে অতিরিক্ত সাক্ষী হাজির ও নথি উপস্থাপন করতে পারবেন। ট্রাইব্যুনাল কোনো শুনানির অডিও বা ভিডিও করতে পারবেন; শুনানিতে অডিও বা ভিডিও দেখাতে পারবেন; ট্রাইব্যুনাল চাইলে ভার্চুয়াল শুনানির আয়োজন করতে পারবেন; সেখানে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হবে না। ট্রাইব্যুনাল বিদেশি আইনজীবীকে বিচারকাজে অংশ নিতে দিতে পারবেন। আগের আইনে এসবের অনুমোদন ছিল না।
এই সংশোধনীর পর শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির অডিও ক্লিপ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে দ্বিতীয় দফা পরিবর্তন আনা হয় চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি। ওই সংশোধনীর নাম রাখা হয় 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫'। সংশোধনীতে আগে আসামি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ছয় সপ্তাহ সময় পেতেন। সংশোধনীতে তা কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়। এতে বিচারের সময় কমে যায়। ট্রাইব্যুনালকে আরও কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে। যেমন– ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য অভিযুক্তের সম্পদ জব্দ করতে পারবেন ট্রাইব্যুনাল। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবেন এবং তল্লাশি ও জব্দ করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তার ট্রাইব্যুনালের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে না।
এই সংশোধনীর পর শেখ হাসিনার মামলার রায়ে তিনি ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর চলতি বছর ১০ মে তৃতীয়বার সংশোধন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও এর সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠন বা ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে বিচারের আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়।
সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর চতুর্থ সংশোধনী অধ্যাদেশ আকারে জারি করে সরকার। এর মাধ্যমে আইনে নতুন ধারা ২০ (সি) যোগ করে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে তিনি আর নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। জনপ্রতিনিধি হয়ে থাকলে সেই পদে থাকার যোগ্যতা হারাবেন। এ সংশোধনীর ফলে গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনারও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
নতুন এ ধারায় আরও বলা হয়, কোনো ব্যক্তি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সদস্য, কমিশনার, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না বা এসব পদে নিয়োগ পাবেন না। এমনকি প্রজাতন্ত্রের (সরকারের) কোনো সেবায় নিয়োগ পাওয়ার অযোগ্য হবেন। তবে ট্রাইব্যুনাল কাউকে অব্যাহতি বা খালাস দিলে তার ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে না।
সংশোধনীর এই গেজেট ৬ অক্টোবর প্রকাশ করা হলেও ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেওয়া হয়। এর অর্থ হলো, আইন যখনই হোক না কেন, আগে থেকে এটা কার্যকর বলে গণ্য হবে। সাধারণত আইনের বিধান হচ্ছে, নতুন আইনের মাধ্যমে পরের ঘটনার বিচার হবে; আগের ঘটনার বিচার হবে না।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেই আইনেও ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুবার সংশোধনী আনা হয়েছিল।
Comments