গণভোট থেকে নতুন সংবিধান পর্যন্ত
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের ভাষণের পর বোঝা গেল - বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৫ সালের 'সংস্কার আলোচনা' সময়টি হয়তো ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে স্মরণ করা হবে। কারণ বহু বছর ধরে অনাস্থা, বিভাজন ও পারস্পরিক অবিশ্বাসে জর্জরিত রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিগুলো —বিশেষ করে বিএনপি, নাগরিক কোয়ালিশন এবং কয়েকটি উদীয়মান দল—সংবিধান ও নির্বাচনী কাঠামো নিয়ে আলোচনায় বসে একাধিক মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
এই সমঝোতার মূল আকর্ষণ নিঃসন্দেহে হলো একই দিনে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব। এটি রাজনৈতিকভাবে সাহসী ও কৌশলগত পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে জনগণ একসাথে ভোট দেবে—একদিকে সংসদীয় প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণে, অন্যদিকে সংবিধানের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ঠিক করতে। এতে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ বাড়বে এবং জনগণ সরাসরি সাংবিধানিক সিদ্ধান্তে যুক্ত হবে—যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের গঠনপদ্ধতি। বিএনপি ও নাগরিক কোয়ালিশন উভয়েই জুলাই সনদের আলোকে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে রাজি হয়েছে। এতে একদিকে নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব আছে, অন্যদিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠনও এর অন্তর্ভুক্ত। এই পদক্ষেপ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে—যা গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সংকট ছিল।
সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হতে পারে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত। নাগরিক কোয়ালিশন ও এনসিপি এই প্রস্তাবে একমত হয়েছে, যদিও জামায়াত ও কিছু অন্যান্য দল আপত্তি জানিয়েছে। উচ্চকক্ষ (Upper House) গঠনের মাধ্যমে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য নির্বাচিত হবে—এটি সংখ্যালঘু মতামত, আঞ্চলিক দল ও ছোট রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব গণতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এছাড়া ৩০ দফা সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়ন– নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারের শক্তিশালীকরণ—এসব প্রস্তাব রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর পরিবর্তনের বার্তা বহন করে। এগুলোর বেশিরভাগই বিএনপি ও নাগরিক কোয়ালিশনের যৌথ অবস্থানে এসেছে, যা তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
যদিও এনসিপি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, নাগরিক কোয়ালিশন এ বিষয়ে সীমিত ক্ষমতার পক্ষে মত দিয়েছে। আবার গণভোটের প্রশ্ন সংখ্যা কমানো ও NOD (National Oversight Document)-এর বিপক্ষে গণভোট না নেওয়ার বিষয়ে জিয়া হাসান ও নাগরিক কোয়ালিশনের অবস্থান তুলনামূলক সংযত ও কৌশলগত। এটি দেখায়, তারা জনমত বিভাজনের বদলে সমঝোতাকে প্রাধান্য দিতে চেয়েছে।
অন্যদিকে, নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সাংবিধানিক পরিষদের ক্ষমতা সীমিত করা এবং ফেব্রুয়ারিতে ভোট আয়োজন—দুটি বিষয়ই গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাস্তববাদী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যায়। এতে দীর্ঘমেয়াদে সাংবিধানিক রূপান্তর মসৃণ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বিএনপির জন্য এই সমঝোতা রাজনৈতিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়াউর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার উদ্ভাবক খালেদা জিয়ার ধারাবাহিকতায় তারেক রহমান যদি এই পর্যায়ে "গণমুখী আধুনিক সংবিধান" প্রবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করেন, তাহলে সেটি বিএনপির রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রাকৃতিক পরিণতি হবে।
সবশেষে নাগরিক কোয়ালিশনের বক্তব্য—"সংস্কারের মার্কা এখন 'হ্যা'"—গণভোটের প্রচারণায় একটি একতাবদ্ধ বার্তা হয়ে উঠেছে। তারা স্পষ্ট করেছে, এই সংস্কার শুধু নির্বাচনের আগ পর্যন্ত নয়; নির্বাচনের পরেও সংবিধান রচনায় তারা সক্রিয় থাকবে।
তবে এই প্রক্রিয়ার বড় ঝুঁকি হলো—গণভোটে পরাজয় মানেই আগের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। এতে সংস্কারপ্রক্রিয়া থেমে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। বিশেষত জামায়াত ও এনসিপির কিছু প্রস্তাব 'বাজে রিস্ক' হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কারণ সেগুলো সংস্কারবিরোধী ভোটকে উৎসাহিত করতে পারে।
তারপরও বলা যায়, এই সমঝোতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধরনের ঐকমত্যের চর্চা শুরু করেছে—যেখানে বিরোধিতা নয়, সহযোগিতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারই মূল সুর। আর এটাই হয়তো ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নতুন সূচনা।
Comments