রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জ্বালানি সংকটে পোশাক খাত মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গ্যাসসংকট ও বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতা নতুন অর্ডার প্রতিবেশী প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর দিকে সরিয়ে নিচ্ছেন। খাতসংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, বর্তমান সংকট অব্যাহত থাকলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও বড় প্রভাব পড়বে।
রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) আয়োজিত 'বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও করণীয়' শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি মো. মোফাজ্জল হোসেন পাভেল।
বক্তারা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবরোধ, লোডশেডিং এবং গ্যাসসংকটের কারণে অনেক কারখানা সময়মতো উৎপাদন শেষ করতে পারছে না। ফলে নির্ধারিত সময়সীমা রক্ষা করতে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীদের অনেকেই ব্যয়বহুল বিমানপথে পণ্য পাঠাচ্ছেন। এতে রপ্তানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ বলেন, "আমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। দেশের সার্বিক অনিশ্চয়তার কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধায় আছেন।"
বিজিবিএর মহাসচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, "গ্যাসসংকট ও প্রতিদিন লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে সময়মতো পণ্য পাঠানো যাচ্ছে না, ফলে ব্যবসায়ীরা বিমানপথে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।" তিনি সরকারের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্য অর্জনে একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়নের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, "টেক্সটাইল ও পোশাক খাত জাতীয় রপ্তানিতে ৮৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে, তবুও আমরা সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছি না।" তিনি ঢাকা বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে দেশের ভাবমূর্তির জন্য "মারাত্মক নেতিবাচক" বলে উল্লেখ করেন।
বিজিএমইএর পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, "গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, বিমানবন্দরের জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক বাধা—সব মিলিয়ে গার্মেন্ট খাত এখন সংকট ব্যবস্থাপনার খাতে পরিণত হয়েছে।"
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও শ্রমিক ইস্যুর জটিলতার কারণে রপ্তানি অর্ডারও প্রভাবিত হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "আমাদের দল ক্ষমতায় এলে এলডিসি উত্তরণের সময় বাড়ানোর জন্য কাজ করবে, যাতে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতির সময় পান।" তিনি দাবি করেন, বর্তমান সরকারের সময়ে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি।
সেমিনারে উত্তপ্ত মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "প্রেস সচিব উন্মাদের মতো কথা বলেন। আমরা সবাই মরে যাচ্ছি, ফ্যাক্টরি বন্ধ হচ্ছে, মানুষ চাকরিচ্যুত হচ্ছে—তিনি কি এসব দেখেন না?"
তিনি আরও বলেন, "যেখানে এয়ারপোর্ট পোড়ে, সেখানে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেবে নাকি? এর অদৃশ্য ক্ষতি অনেক বেশি। সরকারকে বলব—নির্বাচন দিয়ে আমাদের মুক্তি দিন।"
শওকত আজিজ রাসেল প্রেস সচিবের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন মন্তব্যেরও সমালোচনা করে বলেন, "সঠিক লোক যদি সঠিক জায়গায় না থাকে, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তও হবে না।"
বক্তারা একমত হন যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা এবং দক্ষ অবকাঠামো গড়ে তোলাই পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার প্রধান শর্ত।
Comments