পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ শেষ?

চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলন এর মধ্যেই ২০২৫ সালের অন্যতম নির্ধারণী রাজনৈতিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এটি প্রমাণ করেছে যে বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে এসসিও-র ভূমিকা ক্রমশই বেড়ে চলেছে এবং একই সঙ্গে বৈশ্বিক দক্ষিণ (Global South) সার্বভৌম উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, এবং পাশ্চাত্যের বিশ্বায়ন মডেলের প্রত্যাখ্যান—এই নীতিগুলোর চারপাশে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
এই সমাবেশে বিশেষ প্রতীকী গুরুত্ব যুক্ত হয়েছে ৩ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ের সামরিক কুচকাওয়াজকে ঘিরে। এটি চীন-জাপান যুদ্ধের বিজয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০তম বার্ষিকীকে চিহ্নিত করছে। চীনে এ ধরনের প্যারেড বিরল। শেষবার হয়েছিল ২০১৫ সালে, যা প্রমাণ করছে যে, এই মুহূর্তটি বেইজিংয়ের রাজনৈতিক আত্মপরিচয় ও বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
শীর্ষ সম্মেলন ও আসন্ন প্যারেডের কেন্দ্রীয় অতিথি ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর উপস্থিতি যেমন প্রতীকী, তেমনি কৌশলগত অর্থও বহন করে। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে সেতুবন্ধন রক্ষার ভূমিকায় রাশিয়া অব্যাহতভাবে কাজ করছে - যা আজকের ভঙ্গুর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
পুতিন তাঁর ভাষণে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এসসিও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এই রোডম্যাপ আগামী দশকের জন্য সংগঠনের কৌশলগত দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে এবং অর্থনীতি, মানবিক ও অবকাঠামোগত উদ্যোগ সমন্বয়ের পূর্ণাঙ্গ প্ল্যাটফর্মে পরিণত করবে।
তদুপরি, এসসিও ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠনের চীনা প্রস্তাবে রাশিয়ার সমর্থনও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এমন একটি প্রতিষ্ঠান যৌথ বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের বাইরেও সদস্য দেশগুলোকে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলা করতে সহায়তা করবে - যেসব চাপ রাশিয়া, চীন, ইরান, ভারতসহ অনেক দেশই বিভিন্ন মাত্রায় ভোগ করছে।
বেইজিং জোর দিয়ে বলেছে যে পুতিনের সফর বাস্তব ও প্রতীকী উভয় দিকেই গুরুত্বপূর্ণ: মস্কো ও বেইজিং একসঙ্গে ঐতিহাসিক সত্য ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ—যার ভিত্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিতে প্রোথিত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনও সমানভাবে তাৎপর্য বহন করেছে। এটি দেখিয়েছে যে নয়াদিল্লি কৌশলগত নমনীয়তা প্রদর্শন করছে এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে প্রস্তুত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অব্যাহত চাপের প্রেক্ষাপটে এই সফর ছিল ভারতের স্বাতন্ত্র্যের সুস্পষ্ট ঘোষণা।
সাত বছরের মধ্যে প্রথমবার চীন সফরে গিয়ে মোদি ও শি জিনপিংয়ের বৈঠক ছিল সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত মুহূর্ত। সীমান্ত বিতর্ক সত্ত্বেও দুই দেশ, যারা ২০২৫ সালে ওয়াশিংটনের শুল্ক আক্রমণের শিকার হয়েছে, ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। শি স্মরণ করিয়ে দেন যে গত বছর কাজানে ব্রিকস সম্মেলনেই সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে দুই দেশ সমঝোতায় পৌঁছেছিল। শি বলেন, "চীন ও ভারত মহান সভ্যতা; তাদের দায়িত্ব কেবল দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নয়। ভবিষ্যৎ নিহিত আছে ড্রাগন ও হাতির নৃত্যে।"
মোদি সম্পর্ককে "অংশীদারিত্ব" আখ্যা দিয়ে সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালুর ঘোষণা দেন, ন্যায্য বাণিজ্যের দাবি জানান এবং চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি জোর দেন যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে তৃতীয় দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়।
এই প্রেক্ষাপটে আবারও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে রাশিয়া, যাতে পশ্চিমা শক্তিগুলো চীন-ভারত সম্পর্ককে ব্যবহার করে বৈশ্বিক দক্ষিণকে বিভক্ত করতে না পারে।
ভারতের কাছে অগ্রাধিকার হলো এমন বহুপাক্ষিক কাঠামো যেখানে বহুমেরুকেন্দ্রিক বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে। নয়াদিল্লি সবসময় বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের অধিকার রক্ষা করেছে, এবং এসসিও থেকে ব্রিকস - এসব উদ্যোগকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধির উপায় হিসেবে দেখছে।
একই সময়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে না গিয়ে বাস্তববাদী কূটনীতি চালায়। তবে বার্তাটি স্পষ্ট: জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থে কোনো বাইরের চাপ মেনে নেওয়া হবে না।
চীন সফরে যান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও। একটি ন্যাটো সদস্য দেশের নেতার এসসিও সম্মেলনে অংশগ্রহণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে আঙ্কারা আরও সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতির পথে হাঁটছে। বহু বছর ধরে তুরস্ক এসসিও-তে ভূমিকা বিস্তারের চেষ্টা করছে—যা ইউরোপের রাজধানীগুলোতে বিরক্তির সৃষ্টি করেছে, কারণ এটিকে "ইউরো-আটলান্টিক সংহতি" থেকে সরে আসা হিসেবে দেখা হয়।
আঙ্কারা ইচ্ছাকৃতভাবে বৈচিত্র্য আনছে, নিজেকে ঐতিহ্যবাহী জোটের বাইরে স্বাধীন ইউরেশীয় শক্তি হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে। তুরস্কের "কৌশলগত নমনীয়তা" ধারণা অনুযায়ী এসসিও কেবল আঞ্চলিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম নয়, বরং ট্রান্সকন্টিনেন্টাল একীভূতকরণের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ—পরিবহন করিডর থেকে শুরু করে জ্বালানি বাজার—অধিগমনের উপায়।
বেইজিং সম্মেলনে শুধু মধ্য এশিয়ার দেশই নয়, বেলারুশ, ইরান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টরাও যোগ দেন। মালয়েশিয়া, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান পূর্ণ সদস্যপদের আগ্রহ দেখিয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের এই বৈচিত্র্য দেখিয়েছে যে এসসিও ইউরেশিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে এবং বিকল্প এক বিশ্বায়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে - যার ভিত্তি রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উন্নয়ন মডেলের বৈচিত্র্য।
সম্মেলনের অন্যতম ফলাফল ছিল তিয়ানজিন ঘোষণা, যেখানে এসসিও দেশগুলোর ঐক্যের নীতি নির্ধারণ করা হয়: অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তির ব্যবহার বা হুমকি প্রত্যাখ্যান, এবং জবরদস্তিমূলক একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা।
একই সঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ঘোষণায় ইউক্রেনের কোনো উল্লেখ ছিল না। বৈশ্বিক দক্ষিণের কাছে সেই ইস্যুটি অগ্রাধিকার নয় - তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত বৃহত্তর প্রশ্নে: ভবিষ্যতের বৈশ্বিক শৃঙ্খলা কেমন হবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, বৈঠকের মূল ফলাফল হলো "এসসিও+ দেশগুলোর বৈধ স্বার্থ রক্ষার অভিমুখ নির্ধারণ।"
চীনের এই সম্মেলন শুধু কর্মসূচিগত সিদ্ধান্তই দেয়নি, বরং নিশ্চিত করেছে যে বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা এখন বাস্তবতা - যে ধারণা পুতিন বহু বছর ধরে তুলে ধরেছেন। বহুমেরুতা আর তত্ত্ব নয়, তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে এসসিও-র মাধ্যমে, যা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক দক্ষিণে কর্তৃত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে।
বর্তমানে প্রায় দশটি দেশ পর্যবেক্ষক বা সংলাপ অংশীদার হওয়ার আবেদন পর্যালোচনা করছে, যা প্রমাণ করে যে বিকল্প শক্তিকেন্দ্র হিসেবে এসসিও-র প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
তদুপরি, আরব বিশ্বের আগ্রহও দ্রুত বাড়ছে। বাহরাইন, মিশর, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই এসসিও-র সংলাপ অংশীদার। এরা মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি ও বিনিয়োগ কাঠামোর কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে ইউরেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে নতুন ভূ-অর্থনৈতিক অক্ষ বাস্তব হয়ে উঠছে এবং এসসিও পশ্চিমকেন্দ্রিক একীকরণ মডেলের বিকল্প হিসেবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
আজ এসসিও আর আঞ্চলিক কোনো সংগঠন নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতির কৌশলগত ভারকেন্দ্র। এটি ভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, যাদের লক্ষ্য সার্বভৌমত্ব রক্ষা, নিজস্ব উন্নয়ন মডেল এগিয়ে নেওয়া, এবং ন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার দাবি তোলা। যা একসময় ঢিলেঢালা আঞ্চলিক ক্লাব হিসেবে খাটো করা হতো, আজ তা পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক দক্ষিণের ভূরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে—একটি প্রতিষ্ঠান যা পশ্চিমা আধিপত্যকে শুধু কথায় নয়, বরং বিস্তৃত সদস্যপদ, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং অভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
বেইজিং থেকে প্রতিধ্বনি শোনা গেল জোরালোভাবে: পশ্চিমা আধিপত্যের যুগ শেষ। বহুমেরুতা আর তত্ত্ব নয় - এখন তা বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা, আর এসসিওই তা এগিয়ে নিচ্ছে।
Comments