ডাকসু নির্বাচন ফিরিয়ে আনবে ক্যাম্পাস গণতন্ত্র?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের সময় শেষ হয়েছে। তফসিল অনুযায়ী, ১২ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে ১৮ আগস্ট বিকেল ৪টা পর্যন্ত পদপ্রার্থীরা মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ২১ আগস্ট বেলা একটায় চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এখন একটি ভালো নির্বাচনের প্রতীক্ষা।
দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার যে পথের সূচনা হতে চলেছে তাতে কী আমাদের ছাত্র রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে? 'ক্যাম্পাস গণতন্ত্র' বলতে আমরা যা বুঝি তা কি ফিরে আসবে আবার? এই প্রশ্নগুলো উঠছে কারণ বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিই জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে এবং ছাত্র রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে দাঁড়ায়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গণরুম ও 'গেস্টরুম সংস্কৃতির' অবসান হয়েছে। এখন আলোচনা হচ্ছে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, এর আওতা কতটা থাকবে - এসব বিষয়ে। ক্যাম্পাসের পাশাপাশি আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতির 'রূপ' কেমন হবে, এ নিয়েও নানা তর্কবিতর্ক চলছে। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে,এমন প্রত্যাশা সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ছাত্ররাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে, হলে কারও দখলদারত্ব চলুক - এটি চান না শিক্ষার্থীরা। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ যেভাবে 'গেস্টরুম সংস্কৃতির' নামে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালাত, জোরপূর্বক মিছিলে যেতে বাধ্য করত - সেই সব দিনে আর কেউ ফেরত যেতে চান না। স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা দেখে আসছি যখন যে দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্র সংগঠন এমন সহিংস আচরণ করে ক্যাম্পাস গণতন্ত্রকে বিদায় জানিয়ে একক আধিপত্য কায়েম করে। এবার সেই আধিপত্যবাদের অবসানের পাশাপাশি ক্যাম্পাসে - হলে 'গুপ্ত রাজনীতি' নিয়েও কথা উঠেছে। কারণ এখন দেখা যাচ্ছে একটি পক্ষ বিভিন্ন সংগঠনের ভিতরে পরিচয় লুকিয়ে নিজেদের য়ড়যন্ত্রের রাজনীতি করেছে গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়।
প্রচলিত ও গতানুগতিক ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তন চান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেই রাজনীতি তাহলে কোন রাজনীতি সেটাই বোঝা প্রয়োজন। কেন এত বছরেও ছাত্র রাজনীতি বাঞ্ছিত হয়ে উঠলো না, সেই জিজ্ঞাসার সময় এসেছে। ছাত্র রাজনীতির একটা স্বর্ণালী সময় ছিল। অনেক কিংবদন্তীতুল্য রাজনীতিক, এমনকি প্রশাসকও ছাত্র রাজনীতির থেকে এসেছেন। দেশে এই মুহূর্তে কোন ছাত্র আন্দোলন নেই, ফলে গঠনমূলক ছাত্র রাজনীতি নেই। হারিয়ে যাওয়া ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার ছিল লেখা পড়া, বই খাতা, কাগজ কলম,মেধা আর মানুষের জন্য প্রেম। এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হলো মাদক,চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি,ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শনসহ নানা ধরনের অবৈধ বাণিজ্য। খুব সরলীকরণ মনে হলেও বাস্তবতা কিন্তু তা-ই।
দেশের বর্তমান সাংবিধানিক আইন অনুসারে আঠারো বছর বয়স হলেই যে-কোনও নাগরিক নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেন। ভোট দেওয়ার অধিকারের পিছনে যে গণতান্ত্রিক যুক্তিটি রয়েছে,তা হল,নির্বাচনী গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিকের মতামতের মূল্য সমান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আঠারো বা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে কোন রাজনীতি করবে প্রশ্ন হলো সেটি। দলের লেজুড়বৃত্তি করে চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসী হবে,নাকি ভবিষ্যতের একজন সুরাজনীতিক হওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতি কররে?
পশ্চিমা দেশের ছাত্রছাত্রীরাও সক্রিয় রাজনীতি করে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর সমাবেশ বা সংগঠন করার অধিকার সে-সব দেশে সবার আছে। শিক্ষা ও সামাজিক ইস্যুতে সেসব দেশে ছাত্র আন্দোলন হয়,সভা,সমাবেশ ও মিছিল হয়। কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতি আজ যে কারণে নিন্দিত,তার কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক দলীয় অনুপ্রবেশ। ছাত্র সংগঠন সমূহের এখন আর কোন স্বাতন্ত্র্য নেই। বাইরের নেতাদের নির্দেশে বা অপ-নির্দেশে শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রছাত্রীরা চালিত হয়।
বাইরের এই নির্দেশ বা অপ-নির্দেশের কারণে এখনকার ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে নানা দুর্নীতি এবং অর্থকরী কার্যক্রম। যেমন ভর্তি বা সিট বাণিজ্য,ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি যার স্বাভাবিক পরিণাম দলাদলি,বিশৃঙ্খলা আর সহিংসতা। এর ফলে ছাত্র সংগঠন গুলোর স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না,রাজনৈতিক দল আর বহিরাগত নেতাদের অনুপ্রবেশও বন্ধ করা যাচ্ছে না।
২৯ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। কিন্তু সেই নির্বাচন কোন দিক দিয়েই সাধারণ ছাত্র সমাজের আকাঙ্খাকে প্রতিফলিত করেনি। আধিপত্য কায়েম করে দখলের নির্বাচন করেছিল ছাত্রলীগ। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের এরকম দখল মনোভাবের কারণে ছাত্ররা গণতান্ত্রিক উপায় নিজেদের প্রতিনিধি চয়ন করতে পারেননি।
স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের প্রশাখায় পরিণত করে তাদের নিজস্বতা নাই করে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর শাখায় পরিণত করেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছিল। ক্যাম্পাসগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়েছে, ছাত্র সংগঠনের নেতা তারাই হয়েছেন, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের চাহিদা জানেন না বা জানতে চান না, যারা শিক্ষার প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট নন।
এই মুক্ত সময়ে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে দু'দিকেই যুক্তি উঠে আসছে। দলীয় প্রভাবমুক্ত ছাত্র রাজনীতি জরুরি। ছাত্র সংগঠনগুলিকে শুধু খাতায়-কলমে রাজনৈতিক দল হতে বিচ্ছিন্ন করলেই হবে না। সত্যই যেন কোনও সংযোগসূত্র না থাকে,তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু সে শুধু একটি বা দুটি সংগঠনের জন্য যেন না হয়।
এবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে একটি নির্দলীয় অন্তবর্তী সরকার। তাই শাসক দলের সংগঠন বলে সেভাবে কোন সংগঠনের উপস্থিতি নেই। তাই দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি ভাল নির্বাচন হবে, সেটাই প্রত্যাশা।
Comments