এ বাজেট কেমন বাজেট?

বাজেট মূলত তিন প্রকার: ভালো, জনমুখী ও জনস্বার্থবিরোধী। ভালো বাজেট সাধারণত পাওয়া যায় সরকারি মুখপাত্রের বক্তব্যে, যাকে কখনও সখনও জনমুখী বাজেটও বলা হয়। আর জনস্বার্থবিরোধী' বাজেটের দেখা পাওয়া যায় বিরোধীপক্ষ বক্তব্যে। এখন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই। তাই পরষ্পরবিরোধী এমন বক্তব্য আশা করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোিক সরকারগুন বাজেট অর্থনীতি মানেই হলো জিডিপির বাড় বাড়ন্ত। বাজেটেও জিডিপি নিয়ে উচ্ছ্বাসা থাকে প্রতি বছর। কিন্তু অন্তবর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যে বাজেট দিলেন তাতে জিডিপি নিয়ে সেই অর্থে কোন প্রতিশ্রুতি নেই। সরকারের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস আইএমএফের সতর্ক পূর্বাভাসের চেয়েও কম।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ছিল উন্নয়ন এবং সে জন্য একটা প্রকল্প আসক্তিও তৈরি হয়েছিল প্রকৌশলী, আমলা আর ঠিকাদার গোষ্ঠীর মধ্যে। বেশি ছিল মেগা প্রকল্পের কথা। এবার সেই মেগা প্রকল্পের কথাও নেই বাজেটে। তাই এ বাজেট কেমন বাজেট তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তবে কি এ বাজেট স্বপনহীন বা অযথা মোহ তৈরি না করার বাজেট? বলা যেতে পারে বাস্তবতা বুঝে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট।
অর্থ উপদেষ্টা জানেন অর্থনীতিতে সৃষ্ট রোগের তালিকা দীর্ঘ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সমস্যায় জর্জরিত ব্যাংক খাত, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা, বিনিয়োগে খরা এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা ডেকে এনেছে। বড় আশার জায়গা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয়। অর্থ উপদেষ্টা সেগুলো মাথায় রেখেই বাজেট প্রস্তুত করেছেন। এই বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে জিডিপির ৩.৬ শতাংশ, যা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ নতুন অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৭ কোটি ৮৯ লাখ কোটি ৯৯৯ টাকায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন। এটি খুব বড় কাটছাঁট না হলেও, এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তিনি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট চান। এবং একই সাথে খরচ কমাতে চান। সামাজিক ক্ষেত্র যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নাগরিক সুরক্ষার বিষয়গুলোও নজরে আছে সরকারের। এখন দেখার পালা কীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। কম আকারের বাজেট মানেই এরকম গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে উপেক্ষা করা নয়।
সমস্যা হলো সরকারের চলতি ব্যয় কোনভাবেই কমছে না। বাজেট ব্যয়ের একটা বড় অংশ যায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সরকারের পরিচালন ব্যয়ে। সরকারের পরিচালন খরচ কমানো তো যাচ্ছেই না, উপরন্তু এবার মহার্ঘ ভাতাও বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। তাই অপচয় কমানো বা খরচ কমানোর বেশি চাপ যাবে উন্নয়ন প্রকল্পে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছোট করে ফেলায় কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই আশংকা। অথচ বেকারত্বের বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেতে পারতো। বিগত সরকারের উন্নয়নের আড়ালে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এবারে বাজেট তা থেকে বেরিয়ে আসার কোন দিক নির্দেশনা দেয়নি।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে-পরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশ লম্বা সময় স্থবিরতা ছিল। সেটা এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। শ্রমিক অসন্তোষ, সচিবালয়ে অস্থিরতা, এনবিআরে কর্মবিরতি এবং সারাদেশে গলপিটুনি দিয়ে মানুষ মারা ও দখলের উৎসব অর্থনীতির ক্ষতি করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিস্থিতি একেবারেই সন্তোষজনক নয়। রাজস্ব আদায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে রয়েছে। এরপরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধরে রেখেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তারা ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থ উপদেষ্টা কল্পনার ফানুস উড়াতে চাননি। তবে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কোনো রোডম্যাপও দেখা গেল না। বাজেট তো শুধু এক বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়, এটি দেশের অর্থনীতিকে গড়ে তোলার, সংস্কার করার ও নতুনভাবে ভাবার এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। ভতুর্কি কমিয়ে, অবকাঠামোদরিদ্র মানুষের বেকারত্ব কমানো ও আয় বাড়ানো সম্ভব? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বছরান্তে।
বিদেশি ঋণ আরও বাড়বে। এই ঋণ বড় বড় কোনো প্রকল্পের জন্য নেওয়া হচ্ছে না। অর্থনীতি সচল রাখতে এই ঋণ দরকার। বিদেশি ঋণ বাড়ানোর কারণ হলো এমন কিছু বিল, যা শোধ করা ছাড়া উপায় নেই। জ্বালানি খাতের ঘাটতি পূরণ করা জরুরি সেইসঙ্গে অতিরিক্ত ব্যয়ের অবকাঠামোগুলোর দায় এখনো চলছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের এই বাজেট কোনো বড় স্বপ্নের ঘোষণা নেই। চেষ্টা আছে ব্যর্থতা সামাল দেওয়ার এবং অর্থনীতির তরীকে স্থিতিশীল করার। সরকারকে ভারসাম্যের সূক্ষ্ম দড়ির উপর দিয়ে হাঁটতে হবে।
Comments