টাকা সাদা করার বিধান সামাজিক ন্যায্যতার প্রতি বড় হুমকি

গত বছর ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর ২৯ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে কালো টাকা বিধি ও রীতি বাতিল করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সেই সময় সরকারের তরফ থেকে তা ফলাও করে প্রচারও করেছিল। অর্থ উপদেষ্টাসহ একাধিক উপদেষ্টা বিভিন্ন সময় তাদের বক্তব্যেও বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কালো টাকা সাদা করার বিধান রেখেই ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটির সে প্রস্তাব পাস হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার সুযোগ থাকছে।
তবে আগের মতো অবশ্য ঢালাও ভাবে নয়; কেবল স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাজেটে আবাসন খাতে বিদ্যমান কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকলেও তার জন্য বড় আকারের কর গুণতে হতে পারে, যার পরিমাণ হতে পারে বর্তমানের চেয়ে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি। এ পদক্ষেপের লক্ষ্য রিয়েল এস্টেটে কালো টাকার ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা এবং করের হারকে বাজার দামের কাছাকাছি আনা। এ খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে টাকা সাদা করা হলে ওই অর্থের উৎস সম্পর্কে যেকোনো সংস্থার প্রশ্ন করার সুযোগও থাকবে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই দেশের জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার বিধান রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২২ বারে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে ৪০ বছর। তবে সুযোগ দেয়ার পরও দেশে কালো টাকার পরিমাণের তুলনায় যৎসামান্য অংশই কর দিয়ে সাদা করা হয়।
কালো টাকা সাদা করার বিধান প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক সুশসানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, একই সাথে সমাজে বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। কিন্তু তবুও এ পথে সরকার যায় কেন, সেটি এক বড় প্রশ্ন। কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি অসাংবিধানিকও। এর মধ্য দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের অপ্রদর্শিত বা জ্ঞাত উপায়বহির্ভূত আয়কে বৈধতা দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ ধরনের নিয়ম দুর্নীতি বা অবৈধ পন্থায় আয়কারীদের উৎসাহ ও সুরক্ষা দেয়।
বাজেটে এই বিধান রাখার অর্থ হলো কালো টাকা উৎপাদনের সুযোগকে স্বীকার করে নেয়া। কালো টাকা উপার্জন রোধ করতে না পেরে বারবার সরকারকে এ পথে যেতে হচ্ছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একবার বলেছিলেন, কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগ অন্যায্যবোধকে প্রশ্রয় দেয়। সীমিত আকারে ও স্বল্প সময়ের জন্য এ সুযোগ অর্থনীতির জন্য সহায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে এর ক্ষতির কথা তিনি উল্লেখ করেন।
অর্থনীতিতে সাদা-কালোর দ্বন্দ্বটা খুব সরল নয়। জরিমানার পরিমাণ যত বেশিই হোক বা যত কড়াকড়িই করা হোক, কালো টাকা তথা অবৈধভাবে অর্জিত টাকা সাদা করার এই বিধানই কালো টাকাকে উৎসাহিত করে। এই প্রথা সামাজিক ন্যায্যতার প্রতি বড় হুমকি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এরপরও যদি এটি বহাল থাকে, তাহলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল দাবির সাথে তা সংগতিপূর্ণ নয়।
Comments