রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি: বারো বছরেও হলো না বিচার

রানা প্লাজা ধসের ভয়াবহ ঘটনার ১২ বছর পার হলেও এখনো হয়নি বিচার। দগদগে ক্ষত হয়ে আছে সেদিনের স্মৃতি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের ঐ ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক। আহত ও নিখোঁজ বহু মানুষের পরিবার এখনো মানবেতর জীবন যাপন করছে। চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ কিংবা পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ তারা। দীর্ঘ ১২ বছরেও বিচার হয়নি দোষীদের।
ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত ফিরে আসা শ্রমিকরা এখনও নানা শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটেন, কেউ-বা আর্থিক অনটনে সন্তানদের পড়ালেখাও চালাতে পারছেন না। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে দুই দিন আটকে ছিলেন গার্মেন্টস কর্মী জেসমিন। অচেনা এক ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করেছিলেন। এখনো সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। 'দোষীদের বিচার দেখে মরতে চাই'—বললেন তিনি। বরিশালের শীলা বেগম মেয়েকে নিয়ে সাভারে এসেছিলেন ভালো জীবনের আশায়। কিন্তু রানা প্লাজার ইথার টেক্স কারখানায় কাজ করতে গিয়ে ভবনের নিচে চাপা পড়েন। ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার হলেও শারীরিক জটিলতা এখনও কাটেনি। বর্তমানে তিনি টিউমারে আক্রান্ত, অপারেশনের প্রয়োজন হলেও টাকার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ। আজিরন বেগম চিকিৎসা নিয়ে সিআরপিতে দেড় বছর ছিলেন, এখনও চলাফেরা করতে পারেন না।
নিলুফার ইয়াসমিন পা হারানোর মুখে পচনের জন্য, ডাক্তাররা কাটার পরামর্শ দিয়েছেন। হাওয়া বেগম কোমরের আঘাতে পঙ্গু প্রায়, কাজ করতে না পেরে এখন ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১১টি শ্রম মামলা এখনও ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন। দায়রা আদালতে আরও তিনটি মামলার মধ্যে একটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত। বাকিগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। একসময় যেখানে শহিদবেদি ছিল, সেখানে এখন মাদকসেবীদের আড্ডা। প্রভাবশালীরা জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন। বিগত সরকার আমলে শ্রদ্ধা জানাতে আসা স্বজনদের পুলিশ তাড়িয়ে দিয়েছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই এক যুগে অনেক কিছু বদলালেও, বদলায়নি ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন। তারা এখনো অপেক্ষায় সুবিচারের।
শ্রমিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি আইন সহায়তা সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। এক বিবৃতিতে ব্লাস্ট জানিয়েছে, রানা প্লাজার ঘটনায় দায়ের হওয়া ১১টি শ্রম (ফৌজদারি) মামলা এখনও ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর্যায়ে রয়েছে, চারটি মামলার নোটিশ পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় এবং বাকি তিনটি মামলার কজলিস্টে তারিখ বা নম্বর হালনাগাদ হয়নি। এছাড়া দায়রা আদালতে তিনটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে একটি মামলা ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২-এর আওতায় হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। বাকি দুটি মামলা দণ্ডবিধির আওতায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একত্রে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে ইতিমধ্যে ৯৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য হয়েছে আগামী ১৯ মে। ব্লাস্টের তথ্যমতে, শ্রম আইনে নিহত শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত ২ লাখ এবং আহতদের জন্য আড়াই লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বর্তমান বাস্তবতায় অপ্রতুল ও অযৌক্তিক। তারা ভবিষ্যৎ আয়, চিকিৎসা, মানসিক চাপ, পরিবারের পোষ্যদের খরচ এবং আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় ক্ষতিপূরণের হার পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে। ব্লাস্টের পক্ষ থেকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি, গণমাধ্যমে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহি, আইএলও কনভেনশন ১২১ অনুসারে ক্ষতিপূরণ, আহতদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের নামসহ স্মৃতিফলক নির্মাণ।
Comments