নীরব নায়কের গল্প — ৩

শরতের নরম রোদে গা ভাসিয়ে শহরটা যেন আজ এক কবিতার পাতায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতাসে ভেসে আসে শুকনো পাতার খসখসে সুর, আর তার ফাঁকে ফাঁকে জেগে ওঠে অচেনা কোনো স্বপ্নের গন্ধ। জীবন যতই সাদামাটা হোক না কেন, এই বিকেলের আলোয় কোথায় যেন রঙের ছোঁয়া লেগে যায় মনে।
শান্ত রাস্তায় নীরবে হাঁটে অর্না। হলুদ পাতার কার্পেটে মোড়া পথের ধারে দাঁড়িয়ে, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সূর্যের শেষ আলোর দিকে। লাল পাড়ের সাদা শাড়ির আঁচল দুলে ওঠে হালকা বাতাসে। মনটাও যেন দুলে ওঠে— সেই পুরোনো, চুপচাপ একটা স্বপ্নের সাথে, যেটা ধরা দেয় না, হারায়ও না, শুধু নিঃশব্দে অপেক্ষা করে, সংসারের ব্যস্ততার আড়ালে।
ওদিকে রায়হান, অফিস শেষে ক্লান্ত পায়ে ফিরছে। কাঁধে ব্যাগ, ভেতরে লুকানো একটা ছোট্ট খেলনা গাড়ি —তাদের ছেলে রুদ্রের জন্য।
ছেলেটা এখনো সেই বয়সে — যখন হাতে খেলনা ধরেই গড়া যায় একেকটা রঙিন স্বপ্নের বাড়ি। এই ছোট্ট গাড়িটা রায়হানের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উপহার।
ঘরে ঢুকেই সে দেখে, অর্না চুপচাপ বসে। মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয় সারাদিনের ক্লান্তি।
এক কাপ চা এগিয়ে দেয় হাতে, নরম কণ্ঠে বলে ওঠে —
— আজ তোমাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
এই ছোট্ট বাক্যটাই যেন রায়হানের সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে দেয়।
হাসিমুখে খেলনা গাড়িটা লুকিয়ে রাখে,
রুদ্রের জন্য —
একটা ছোট্ট চমক।
তারপর, অর্না বলে —
— চল না, কাশফুলের সাথে একটা ছবি তুলে আসি।
রায়হান এক মুহূর্তও না ভেবে রাজি হয়ে যায়।
সংসার বড় কিছু চায় না, শুধু এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই ওদের পৃথিবী ভরিয়ে তোলে।
দেয়ালের ফ্রেমে পুরনো ছবি —
তার মাঝখানে জমে থাকা নতুন ঠিকানার স্বপ্ন।
একটা ঠিকানা, যেখানে রুদ্র মুক্ত আকাশের নিচে বড় হবে। যেখানে শরতের আলোয় সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাবে তার জানালার পাশে।
আজকাল প্রবাদটাও বদলে গেছে —
সংসার সুখের হয় তখনই,
যখন দু'জন মিলে একে-অপরের ছোট ছোট সাফল্যে গর্ব করে,
প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়।
রায়হান আর অর্না জানে —
প্রতিদিনের এই ছোট্ট প্রশংসাই
তাদের ক্লান্ত দুপুরের অবলম্বন।
অর্না রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু বানালে,
রায়হান একবাক্যে বলে —
— তোমার রান্নায় আজ এক অন্যরকম স্বাদ।
আর কোনোদিন রুদ্রকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে,
অর্নার কোলের উপর মাথা রেখে বলে —
— তোমার মতো মা পাওয়া রুদ্রের জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ।
সুখ আসলে কখনো বড় কিছুর উপর দাঁড়ায় না।
একটি মৃদু 'তুমি ভালো করেছো' বলাটাই যথেষ্ট।
গোধূলির আকাশের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে রায়হান।
পেছন থেকে এসে অর্না পাশে দাঁড়ায়।
রায়হান ওর হাত ধরে ধীরে বলে —
— একদিন ঠিকানা হবেই আমাদের, অর্না।
রুদ্রের জন্য, আমাদের জন্য।
শুধু সময় আর বিশ্বাস চাই'।
অর্না নীরবে মাথা নাড়ে। কোনো শব্দ হয় না,
কিন্তু সেই নিঃশব্দ সম্মতিতেই জমে থাকে
অটুট ভালোবাসা আর ধৈর্যের প্রতিজ্ঞা।
এই গল্পের নায়ক রায়হান নয়, অর্নাও নয়।
এই গল্পের নায়ক—সেই নিঃশব্দ অপেক্ষা,
ছোট্ট প্রশংসা আর কাঁটায় ঘেরা স্বপ্ন দেখতে শেখা
সাধারণ মানুষগুলো।
কারণ নীরব নায়কেরা আলোচনায় আসে না।
তারা কেবল তাদের পরিশ্রম, ভালোবাসা আর সময়ের বিনিময়ে
গড়ে তোলে ছোট্ট একখানা সুখের ঠিকানা।
ঠিক যেমন —
একটি আন্তরিক 'ভালো করেছো' বদলে দিতে পারে কারো পুরো দিন।
কাশবনের সেই পুরনো ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে
অর্না তাকিয়ে থাকে। সেখানে জমে আছে অনেক স্বপ্নের গল্প। তার কাছে দেয়ালের এ ছবিটা গয়নার থেকেও প্রিয়।
Comments