নীরব নায়কের গল্প — ২

মানুষ বদলে যায়। সময়ের হাত ধরে, অভ্যাসের বুননে কিংবা নিজের ভিতরের শূন্যতার জমে ওঠা ভারে। বদল কখনো আত্মরক্ষার জন্য, কখনোবা কেবল নতুন কোনো আশ্রয়ের খোঁজে। এই শহরের প্রতিটি মানুষ যেন নিজের চেহারার নিচে লুকিয়ে রাখে আরেকটি মুখ, আর সেই মুখের নাম — একাকিত্ব।
অর্না জানালার কাচে আলতো হাত রাখে। বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে — যেন তার মন থেকে নেমে আসা দীর্ঘশ্বাসের সুর। এই বৃষ্টির শব্দ তার ভিতরের সমস্ত প্রশ্ন ধুয়ে মুছে দেয় না, বরং আরও গাঢ় করে তোলে। জীবন তো কেবল মিলন আর বিচ্ছেদের সরল অঙ্ক নয়; এর শেষ হয় বোঝাপড়ার গভীরতায়।
সে জানে, কাউকে আটকে রাখার সাধ্য কারও থাকে না। মানুষ আসে, যায় — সময়ের নিয়মে।
তবুও কিছু মুহূর্ত থাকে, যা কখনো হারায় না।
সেই এক বিকেলের গল্প।
চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে অর্না এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছিল। বাতাসে কাঁচা বৃষ্টির গন্ধ, পুরনো দিনের মতোই মনকে অচেনা শূন্যতায় টেনে নেয়।
নরম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই চমকে ওঠে সে। বুকের কাছে বইটা শক্ত করে চেপে ধরে আশ্রয় নেয় ফুটপাথের কোণের চায়ের দোকানের ছায়ায়। ভিড়ের মধ্যেও মনে হচ্ছিল, সে যেন অদৃশ্য কোনো খাঁচায় আটকে আছে।
ঠিক তখনই রায়হান ছাতা হাতে এসে দাঁড়ায় তার সামনে।
চোখের কোণায় জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো, অর্নার মনটাকেও নরম করে দেয়।
রায়হান প্যান্টের ভাঁজ ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করে —
— এখানে? একা?
অর্না মাথা নিচু করে, নরম গলায় বলে —
— গাবতলী যেতে হবে।
রায়হান ছাতার হাতলে আঙুল ঘুরিয়ে নিয়ে বলে —
— আপত্তি না থাকলে, পৌঁছে দিতে পারি।
সম্মতির ইশারায় মাথা নাড়ে অর্না।
রিকশায় ওঠে দুজন। মাঝখানে নীরব দূরত্ব — যেন দুই অচেনা মানুষের অলিখিত বোঝাপড়া। রিকশার চাকা ঘুরতে থাকে। শহরের ঝাপসা আলোয়, বৃষ্টিভেজা রাস্তায়, জন্ম নেয় এক নিঃশব্দ, অদৃশ্য বন্ধুত্ব।
তারপর সময় কেটে যায়।
অর্না হারিয়ে যায় জীবনের ব্যস্ত স্রোতে। রাতের শেষ প্রহরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে পুরনো সেই ট্রাফিক লাইট, সেই থেমে থাকা গাড়ির সারি। পুরনো বিকেলের স্মৃতিগুলো যেন নিঃশব্দে ফিরে আসে। রায়হানও বদলে যায়।
যে মানুষ একসময় বাজারের হিসেব কষে বলত —
— এবার তো দু'দিন চলে যাবে, কী বলো?
সেই রায়হান আজ সফলতার আলোয় মোড়ানো পরিচিত মুখ। পার্টির রঙিন আলোয় হাতে মদের গ্লাস, মুখে অপরিচিত হাসি। চোখের গভীরতা যেন বদলে গেছে, হয়তো সেই চোখ আজ আর কারও জন্য অপেক্ষা করে না।
একদিন, এক পরিচালকের বাসায় গিয়েছিল তারা।
ঘরের কোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে অর্না দেখছিল — রায়হান কীভাবে আরেকটা মুখোশ পরেছে।
ডিনারের টেবিলে মাতাল ভঙ্গিতে রায়হান হঠাৎ বলে ফেলে —
— তুই তো দেখছি, শুধু খেতেই জানিস!
ঘরের ভেতর শব্দ থেমে যায়।
সব চোখ ঘুরে আসে অর্নার দিকে।
সে চামচ নামিয়ে রাখে, ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হয় না।
স্মৃতির গলিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অর্নার মনে পরে —
ছোট্ট সেই ভাড়া বাসা, শীতের সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে পিঠা বানানোর গল্প।
রায়হানের সেই স্নিগ্ধ কণ্ঠ —
— তোর জন্যই আনলাম, বুঝলি? টাকা কম পরেছিল, তাই চায়ের সাথে দুটো বেগুনি আনতে পারলাম।
বিয়ের পরের রাত, অন্ধকার ঘরে ফ্যানের শব্দে ঢাকা স্বপ্নের কোলাজ।
লাউ-চিংড়ির ঝোল রান্না করা দুপুর আর হাসিমাখা দিনগুলো।
আর এখন?
রায়হান পরিচিত মুখ, মুখোশের দেয়ালে ঘেরা এক মানুষ।
রাতের শেষে ক্লান্ত দেয়ালের মতো ঘরে ফেরে। ফোন চার্জে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যায়।
ভোর হলে আবার সেই একই চেনা ছন্দ — প্রেসক্লাব, সাহিত্য সভা, পরিচিত মুখের ভিড়।
অর্না শুধু দেখেই যায় — কীভাবে এক মানুষ ধীরে ধীরে নিজের চারপাশে মুখোশের দেয়াল তুলে ফেলে।
রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবে —
মানুষ কি সত্যিই এত সহজে বদলে যায়?
যে মানুষ একদিন নীরব সঙ্গী হয়ে পাশে ছিল, তার ছায়া হয়ে, সেই মানুষ আজ এত দূরের হলো কীভাবে?
সব স্মৃতি যেন বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া জানালার কাচের মতো —
অস্পষ্ট, মলিন, অথচ কষ্টের মতোই প্রখর।
বৃষ্টি থেমে যায়।
অর্না জানালার কাচে জমে থাকা ফোঁটা মুছে দেয়।
নীরবতার গায়ে জমে থাকা স্মৃতিগুলোও কি এভাবে মোছা যায়? হয়তো যায় না।
অর্না জানে —
গল্পের শেষ মানে গন্তব্যে পৌঁছানো। সময়ের ট্রেন থেমেছে। এখন তাকে নেমেই পরতে হবে।
Comments