পার্কে হাঁটা শুধু ব্যায়াম নয়, এটা একপ্রকার ধ্যান

ঢাকার প্রায় সব এলাকায় এখন স্পোর্টস শপ চোখে পড়ে। সেখানে খেলাধুলার সামগ্রীর বাইরে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় হাঁটার যন্ত্র ট্রেড মিল। কন্ক্রিটের নগরীতে সব জায়গায় পার্ক নেই, আর থাকলেও কাজের চাপে, আরও নানা কারণে অনেকে পার্কে যান না। তাই তারা ঘরে বা পাড়ার জিমে ট্রেড মিল করেন।
কিন্তু পার্কে হাঁটার কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। প্রথমত প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেকের সঙ্গে হাঁটলে যে মানসিক আরাম পাওয়া যায়, ঘরে বা জিমে তা পাওয়া যায় না৷ যারা ভোরে হাঁটেন তারা রোদটা শরীরে লাগাতে পারছেন, পাচ্ছেন ভিটামিন ডি,যার অভাব আজ ঘরে ঘরে৷ তা ছাড়া ট্রেডমিলের সমতল পাটাতনে এক ভাবে হেঁটে গেলে শরীরের যে যে পেশীর ওয়ার্কআউট হয়,মাঠে হাঁটলে এখানে উঁচু ওখানে নিচু, এখানে-ওখানে এবড়োথেবড়ো-তার সুবাদে পা ও কোমরের পেশীর বেশি উপকার হয়।

পার্কে হাঁটা শুধু শারীরিক ব্যায়াম নয়, বরং একধরনের মানসিক প্রশান্তির যাত্রা। ব্যস্ত, যানজটপীড়িত, ধুলো-ধোঁয়ায় ভরা এই শহরে পার্ক যেন এক টুকরো স্বস্তির নিশ্বাস। দিনের পর দিন কংক্রিটের দেয়ালের মধ্যে আটকে থাকা মানুষ, অফিস আর বাসার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মন - সব কিছুর জন্য ঢাকার পার্কগুলো একরকম মুক্তির জানালা খুলে দেয়।
ভোরবেলা ঢাকার যে কোনো বড় পার্কে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে কুয়াশা-ঢাকা সবুজ মাঠ আর উঁচু গাছের ছায়া। বোটানিক্যাল গার্ডেন, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হাতিরঝিলের ওয়াকওয়ে, পাড়া মহল্লার পার্ক - সবখানেই ভোরের এক নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে। ফাঁকা রাস্তায় শুধু পাখির ডাক, গাছের পাতায় শিশিরের ঝিলিক - এগুলো মিলে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। এ সময়ে হাঁটাহাঁটি করতে করতে শরীরে একধরনের সতেজতা অনুভূত হয়, যা দিনের শুরুতে ইতিবাচক শক্তি এনে দেয়।

পার্কে হাঁটার আরেকটি সৌন্দর্য হলো মানুষের মেলবন্ধন। সেখানে একসাথে দেখা মেলে বিভিন্ন বয়স,পেশা ও সামাজিক পটভূমির মানুষের। কেউ আসেন একা, নিজের ভাবনায় ডুবে; কেউ আসেন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে হাঁটার জন্য; আবার কেউ পরিবার নিয়ে আসেন-শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করে, বয়স্করা বেঞ্চে বসে রোদ পোহান। হাঁটার পাশাপাশি অনেকেই যোগব্যায়াম বা হালকা ব্যায়াম করেন। এটা যেন শহরের মধ্যে এক ছোট্ট সামাজিক মিলনমেলা।
ঢাকার পার্কে হাঁটা শুধু সকালে সীমাবদ্ধ নয়। বিকেলের দিকেও এর আলাদা আমেজ আছে। কাজ শেষে বা পড়াশোনার চাপ কাটিয়ে অনেকে হাঁটার জন্য বের হন। গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের শেষ আলো পড়া,দূরে বসে প্রেমিক-প্রেমিকার মৃদু আলাপ,বন্ধুরা গল্পে মশগুল-সব মিলিয়ে বিকেলের পার্কে একধরনের ধীর ছন্দ থাকে। কিছু পার্কে দেখা মেলে আড্ডার টেবিল, কফি বা চায়ের স্টল, যা হাঁটার বিরতিতে বাড়তি আনন্দ এনে দেয়।

ঢাকার পার্কগুলো যদিও শান্তি দেয়, তবুও কিছু সমস্যাও আছে - যেমন পরিচ্ছন্নতার অভাব, নিরাপত্তা সমস্যা বা দখলদারিত্ব। অনেক পার্কেই অপর্যাপ্ত আলো ও নিরাপত্তার কারণে সন্ধ্যার পর হাঁটা নিরাপদ নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু পার্ক সংস্কার হয়েছে,নতুন ওয়াকওয়ে, লাইটিং ও বেঞ্চ বসানো হয়েছে,যা হাঁটার অভিজ্ঞতাকে আরও আরামদায়ক করেছে।
শরীরচর্চা ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য নিয়মিত হাঁটার বিকল্প নেই। ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরে পার্কে হাঁটা শুধু ব্যায়াম নয় - এটা একপ্রকার ধ্যান। গাছের পাতার ফাঁকে আকাশ দেখা,পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ শোনা, কিংবা হালকা বাতাসের ছোঁয়া পাওয়া - এসব মুহূর্ত জীবনের চাপ, ক্লান্তি আর একঘেয়েমি অনেকটাই দূর করে দেয়।
তাই ঢাকার পার্কগুলো কেবল সবুজ জায়গা নয় - এগুলো শহরের মানুষের জন্য পুনর্জীবনের জায়গা। এখানে হাঁটার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ধুলোমাখা জীবনে একটু সতেজ বাতাস এনে দেয়, আর মনে করিয়ে দেয় - যতই কোলাহল থাকুক, ঢাকার বুকে এখনো কিছু জায়গা আছে যেখানে মন খুলে শ্বাস নেওয়া যায়।
Comments