‘স্লিপ প্যারালাইসিস’ আসলে কী?

ঘুম ভাঙলেও শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে কেউ যেন বুকের ওপর চেপে বসে আছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কারও কারও চোখে ভেসে ওঠে কাল্পনিক ভূত, দৈত্য বা অদ্ভুত সব প্রাণী। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাই হলো 'স্লিপ প্যারালাইসিস' বা 'ঘুমের জড়তা', যার শিকার হন পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে গবেষক ড. বালান্দ জালাল 'স্লিপ প্যারালাইসিস' নিয়ে অনেক বছর ধরে গবেষণা করছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সময়টা ২০০৫ তখন আমার বয়স ১৯। ঘুম ভাঙার পর হঠাৎই এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়েছিলাম। কথা বলতে পারছিলাম না, শরীর নাড়ানোর ক্ষমতাও ছিল না। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন পা ধরে নাড়িয়ে দিচ্ছে এবং শ্বাসরোধ করে মারতে চাইছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমি মারা যাচ্ছি,। এই অভিজ্ঞতাই তাকে স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে গবেষণায় অনুপ্রাণিত করে।
কেন হয় স্লিপ প্যারালাইসিস: গবেষক ড. বালান্দ জালাল প্যারালাইসিস প্রসঙ্গে জানান, ঘুমের একটি ধাপ হলো র্যাপিড আই মুভমেন্ট (আরইএম), যেখানে আমরা স্বপ্ন দেখি। এ সময় মস্তিষ্ক আমাদের শরীরকে অচল করে রাখে যেন আমরা স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব কোনো ক্ষতি না করি। কিন্তু স্লিপ প্যারালাইসিস ঘটে তখনই, যখন আমাদের চেতনা ফিরে আসে কিন্তু শরীর এখনো র্যাপিড আই মুভমেন্ট অচলাবস্থায় থাকে।
এই অবস্থায় মানুষ ভয়াবহ বিভ্রম দেখতে পারে যা অনেক সময় দেখা যায় ভূত, ছায়ামূর্তি, এলিয়েন বা অদ্ভুত প্রাণীরূপে। মনে হয় তারা আমাদের উপর ভর করছে, শ্বাসরোধ করছে বা ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। গবেষক জালালের মতে, প্রায় ৪০ শতাংশ স্লিপ প্যারালাইসিস আক্রান্ত ব্যক্তি এ ধরনের বিভ্রমের সম্মুখীন হন, এবং তাদের ৯০ শতাংশের কাছেই তা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
বিভ্রমের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা: জালালের গবেষণায় দেখা গেছে, বিভ্রমের ধরণ ও ব্যাখ্যা সংস্কৃতি অনুসারে পরিবর্তিত হয়। মিশর ও ইতালির মানুষরা একে জিন বা ডাইনি হিসেবে দেখেন, আবার ডেনমার্ক বা আমেরিকার কেউ কেউ এ অভিজ্ঞতাকে মানসিক বা শারীরিক ব্যাখ্যায় দেখেন তাতে ভয়ও কম অনুভব হয়।
কাদের ঝুঁকি বেশি: বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুমের ব্যাঘাত, অনিয়মিত ঘুম, মানসিক চাপ, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, এডিএইচডি-এর ওষুধ, মাদকাসক্তি, নিদ্রাহীনতা বা নারকোলেপসি এসবই স্লিপ প্যারালাইসিসের সম্ভাবনা বাড়ায়। এমনকি ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ যেমন অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াও একটি কারণ হতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিস ভয়ানক মনে হলেও তা শরীরিকভাবে ক্ষতিকর নয়। তবে ঘন ঘন ঘটলে মানসিক উদ্বেগ, ঘুম এড়িয়ে যাওয়া, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত এবং কখনো ট্রমার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিকার ও নিয়ন্ত্রণ: বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ ওয়াকারের মতে, নিয়মিত ঘুম ও ভালো ঘুমের অভ্যাসই হলো প্রথম করণীয়। প্রতিরাতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এবং ঘুমের সময় ঠিক রাখতে হবে। একেকদিন একেক সময় না ঘুমানো ভালো। একইসঙ্গে মানসিক চাপ হলে সেটা কমানো চেষ্টা। এছাড়াও মেডিটেশন সহায়ক হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে স্লিপ থেরাপি, যেমন ইনসমনিয়ার জন্য কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি, কার্যকর। আর কিছু ক্ষেত্রে এসএসআরআই বা ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ব্যবহার করা হয়।
মেডিটেশন রিলাক্সেশন থেরাপি: অন্যদিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে গবেষক ড. বালান্দ জালাল নতুন একটি থেরাপি তৈরি করেছেন। যেটার নাম 'মেডিটেশন রিলাক্সেশন থেরাপি'। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আট সপ্তাহের এই চিকিৎসায় স্লিপ প্যারালাইসিস ৫০ শতাংশ কমেছে। এই থেরাপির ধাপগুলো হলো:
আক্রমণের মানে পুনর্বিবেচনা: চোখ বন্ধ করে নিজেকে বোঝানো যে এটি স্বাভাবিক এবং এর কারণে মৃত্যু হবে না।
ভবিষ্যৎ ভয়ের থেকে নিজেকে আলাদা রাখা: স্লিপ প্যারালাইসিস হলে ভয় পাওয়া যাবে না। নিজেকে বোঝাতে হবে যে মস্তিষ্ক কেবল খেলছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ইতিবাচক কল্পনায় মনোযোগ দেয়া: স্লিপ প্যারালাইসিস হলে ইতিবাচক কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। এসময় প্রিয়জনের মুখ ভাবা বা শান্ত ছবি কল্পনা করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ।
মাংসপেশি ঢিলে রাখা ও নড়াচড়া না করা: কারণ মুভমেন্ট চেষ্টা করলে বিভ্রম আরও বাড়তে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিস কোনো অলৌকিক বিষয় নয় এটি একটি বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ঘুমের ব্যাঘাত। ভয় বা কুসংস্কারের বদলে যদি আমরা এই অভিজ্ঞতাকে বুঝে নিই, তবে আতঙ্ক নয়, সচেতনতা দিয়েই এটি মোকাবিলা করা সম্ভব। নিয়মিত ঘুমের অভ্যাস, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ঘুমের আগে শরীর-মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা আমাদের এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখতে পারে। মনে রাখতে হবে 'স্লিপ প্যারালাইসিস' এক রহস্যময় ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা হলেও, এটি বোঝা ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সূত্র: সিএনএন
Comments