বদরুদ্দীন উমরকে নিয়ে...

একটি বৃদ্ধ বায়স লোকান্তরিত হয়েছে। পলিটব্যুরো তরফের এলিট বুড়ো। ট্রেনটা ফেল করেছিল বাপ, তারপর সেই আক্ষেপে অন্তত ৭০ বছর ধরে আভিজাত্য মোড়ানো ইতরামির বেসাতি করে গেল একটা লোক। মাফ করে দেয়া যেত নিশ্চই, এদেশে যেটা দস্তুর, মরে গেলে...।
করা গেলনা, কেননা, নরহত্যার চাইতে ফিৎনা বা ফ্যাসাদ বড় পাপ। কবীরা গুনাহ।
স্রেফ ঈর্ষা, ইগো আর পরশ্রীকাতরতার মতো ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলোকে হ্যান্ডল না করে একটা বদস্য বদ উমর স্রেফ মিথ্যাচার করে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অবিকশিত জনপদের ২০ কোটি মানুষের জীবন, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যতকে বীভৎস জিঘাংসায় পায়ে দলে, দুমড়ে মুচড়ে যেতে থাকল যুগের পর যুগ। বিভেদের বাঁশীতে বাতাস দিতে থাকল।
বড়ো বাপ, আইভি লীগ, কৈলকাতার মহানাগরিক ঘটি, চোস্ত ইংরেজী কয় ...OMG!!!
স্কন্ধকাটা স্তাবককূলের চোখে এক্কেবারে দিব্যজ্যোতি মুরশিদ কার্ল মার্কস স্বয়ং। লিলিপুটের দেশে ব্রবডিংনাগ। আর এই স্তাবকবাজির ধোয়ার অন্তরালে বিনির্মিত হতে থাকল পতিত মুসলিম লীগের প্যারালাল ন্যারেটিভ।
প্রায় পঞ্চাশে এসে ভাবি, আমার আগে-পরের প্রজন্মের চোখে সাম্যবাদ কী মহত্তর অঞ্জনই না এঁকে দিয়েছিল। একটা লোক শুধু বললো নাস্তিক সে, শ্রেণিহীন সে, আমরা কাছা খুলে তার পায়ে পরতে কাণ্ড বাধিয়ে ফেললাম। আজ আবার লোকজন ফাতওয়া দিয়েছে, কম রেড না হলে বদের বদমাইশি নিয়ে কথা বলা যাবে না।
প্রথমেই বলে রাখি, বনু হাশিমের প্রায় চার কুড়ি বইয়ের মধ্যে আমি পড়েছি মোটে গোটা ছয়েক, প্রথম দিককার। পরে ফ্ল্যাপ, ভূমিকা, সূচি, ইন্টারেস্টিং মনে হলে এক আধটা প্রবন্ধ এককালে নেড়েচেড়ে দেখেছি, আরো ডজন খানেক কিতাবের, ব্যাস। নতুন কি লিখছেন খবর রাখতে ভুলিনি। তবে গত ৩০ বছরে প্রকাশিত ৮০ শতাংশ সাক্ষাৎকার আমি পড়েছি বা দেখেছি। প্রতিটা পলিটিকাল মুভ আমার স্মরণে...
উনি চিরটা কাল, প্রতিটে দশকে একেকটি আনত বিনয়ে নতুন খুঁটি বাঁধা বরাহ শাবকের কাছে সাক্ষাৎকার দিলেন, সেগুলো কিছুদিন ন্যাজ নাড়লো। নয়তো পুরানো পরীক্ষিত 'করে নাকো ঠুশঠাস' ঢোঁড়ার কাছে , সেটাও দেখার মত। পারস্পারিক সম্মতি বিশেষে পিঠ চুলকে দেয়া ইন্টারভিউ। কম বয়সে অবাক হয়ে ভাবতাম, একটা লোক দিনের পর দিন প্রকাশ্যে মিথ্যা বলছে টুইস্ট করছে, কোন সাক্ষাতকার গ্রহীতাই ওনাকে চেপে ধরছে না কেন? মুখের ওপর দলিল ছুঁড়ে মেরে বলছে না কেন , "বুইরা ভাম, বাহাত্তর তো পার হইয়া গ্যাছে, বয়স হইছে বাতাসে" ? জিজ্ঞেস করছে না -"এই ইনফো টুইস্ট করছেন কেন "?
পরে বুঝেছি সব সেটিং দেয়া। উনি বাউন্সি পীচে খেলেন না। ফিক্সড ম্যাচে ডানলপ বলে নিজের গলিতে দুধভাতদের সাথে ছক্কা মেরে পাশের বাড়ির জানালার কাচ ভাঙেন। আর তাতেই খুব হাততালি। আর নয়তো শ্রদ্ধার ব্যামো। কি বড় বাড়ির ছেলে! কি বাপ! কি নামডাক! কথা কইছেন, তাই তো যেন সিম্ফনি!!!
আসাদুজ্জামান নূর আর খালেদ মহিউদ্দিনের শোতেও খুব কুসুম কুসুম আলেচনা। শ্রদ্ধায় নুয়ে চকোলেটের মতো গলে যাচ্ছে সব। আহা...
স্টিভেন সাকার, করন থাপার বা মাহাদি হাসানের মত কেউ লাইন বাই লাইন কোট করে , ডকুমেন্ট ফেলে, বীচি চেপে ধরে জানতে চায় না, প্রতি দশকে আরো সাম্প্রদায়িক ডানপন্থার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন বয়ান উৎপাদন করে যাচ্ছেন কেন?
যেই লোক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭), সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৮) লেখেন, সেই ডার্টি ডিক ২০২৪ এর চূড়ান্ত সংকটকালে একের পর এক ভিডিও সাক্ষাতে বলে যাচ্ছে, "এই বঙ্গে কোনও দিন সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেনি, সবই রাজনৈতিক। সবই ভারত করায়।" কলাম লিখছেন প্রথম আলোতে। আর কমপক্ষে দেড়কোটি সংখ্যালঘু তখন সীমাহীন আতঙ্কে দিন পার করছে।
নাস্তিক ধর্মহীন ভেকের আড়ালে একটা কট্টর ইসলামিস্ট এনাবলার। প্রতিটা লাইনের ভাঁজে ভাঁজে সাম্প্রদায়িকতা বলা ভালো হিন্দু ঘৃণা মজ্জায় আর তার বয়ান নির্মানে নিয়ত মিথ্যাচার। সত্য আর মিথ্যার মিশেলে চটকদার রেসিপি। একবার ভাবুন তো, রেড মাওলানা, আবুল হাশিম, কোনজন এই সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে ? প্রত্যেকেই ফেলো মুসলিম লীগার। এদের ভিটে হারানো দেশভাগের ট্রমাই কি মূল কারন? আমার পিতা, আমার জীবন পড়া হলো না এখনো এবার পরে দেখব।
আর এই বামাচারিরা, প্রত্যেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধাচারন করতে গিয়ে দাড় করিয়েছেন পতিত মুসলীম লীগের থিসিস। খেয়াল করে দেখুন বদরুদ্দিন উমর, আবুল হাশিম, মাওলানা ভাসানি কারও কোন পলিটিকাল এজেন্সি নাই, সাবস্ক্রাইবার নাই । আছে শুধু তত্ত্ব। কেউ এদের দল করে না। রাজনীতিটা করেনা। সবাই কোট করে। কারা করে ? রেডিক্যাল বামরাও নয় কিন্তু , ওনাকে কোট করে সমস্ত ডানপন্থীরা। সুড্যো, সেমি, কাঁচা, পাকা, জেহাদি সব ডানের কণ্ঠে আল্লামা উমরের বাণি। তবে এখানে তিনি অনন্য, দূরন্ত মেধাবী। ১০ বছর আগে জুলাই অভ্যূত্থানকে তত্ত্বায়ন করেছিলেন নিখুঁত ভাবে।
লোকটার যে দক্ষতা, যোগ্যতা ছিল না তা তো নয়। ক্ষমতা, যোগ্যতা, স্বাস্থ্য, সুযোগ, পরিবেশ, মেধা, কোটা সবই ছিল তার অনুকূলে। আর এমন নয় উনি অর্থ লোভি, ক্ষমতা লোভী মানুষ ছিলেন। ওনাকে আমার বরং তারাশংকরের জলসা ঘরের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত মনে হয়। সব গেছে ঠাট বাঠ,পয়সা কড়ি। কীভাবে মোসাহেব ধরে রাখতে হয়, তাও জানেন না। আছে শুধু অদম্য জেদ আর স্বীকৃতির অনন্ত তৃষ্ণা। সঙ্গী ঈর্ষা আর প্রতিশোধস্পৃহা।
বদরুদ্দিন উমর হতে পারতেন যে কোনও দলীয় ক্ষুদ্রতার বাইরে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সব থেকে নির্ভর যোগ্য ভাষ্যকার। যথার্থ অথরিটিতে নাকচ করে দিতে পারতেন আওয়ামী লীগের তেলসা ভার্সন। এ সুযোগ সকলে পায় না। হায়, জিঘাংসার অনলে হইলেন ডানপন্থীদের ফুট সোলজার। দুঃখ এই, এমাটিতে আর মহীরূহ জন্মাবে বলে আশা হয় না।
Comments