পুরাতনের হৃদয় টুটে নতুনের জয়গান
আরও একটা নতুন বছর এলো। কিন্তু যে বছরটা পেছনে ফেলে এল বাংলাদেশ, তা একেবারেই আলাদা স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে। ছাত্র জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা, যিনি দুর্দন্ড প্রতাপে শাসন ক্ষমতায় ছিলেন দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময়। হাজার খানেক খুন আরও হাজার হাজার মানুষকে হত্যা চেষ্টার অপরাধে তার এবং তার সহযোগীদের বিচার চলছে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
এই আন্দোলনের পর মানুষের মনে নতুন করে মুক্তির স্বাদ জাগিয়েছে। ২০২৪ এর জুলাই বৈষম্যবিরোধী প্রতিবাদ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। কিন্তু এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের সরকারি চাকরির বাজারের বৈষম্যের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ছিল না, আর ছিল না বলেই আন্দোলনটি সর্বজনীন রূপ নিয়েছিল। কারণ এই আন্দোলন ছিল আপামর মানুষের নিপীড়ন, বঞ্চনা আর অবিচার বিরোধী সংগ্রাম।
গণতন্ত্র, ভোটাধিকার হরণকারী শাসক দল আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অত্যাচারী আচরণ শেখ হাসিনার শাসনামলকে ফ্যাসিবাদের যে তকমা দিয়েছে তা আজীবন ইতিহাসে থেকে যাবে।
দেশে অন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়েছে ৪ মাসেরও বেশি আগে। নোবেল জয়ী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে এই সরকারে রয়েছেন শেখ হাসিনার সরকারের একচেটিয়া অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের প্রতিনিধি। এই সময়ে সরকার নানা প্রচেষ্টায় সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। একটা বড় সাফল্য এসেছে ব্যাংকিং খাতে। এস আলম, সালমান এফ রহমানদের মতো দানবদের হাতে ঋণের নামে ব্যাংক লুট বন্ধ হয়েছে এবং দেওলিয়া হওয়া থেকে অনেকগুলো ব্যাংক-কেই বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। প্রশাসনকে জনমুখী করার সরকারি প্রচেষ্টা দৃশ্যমান। তবে সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি প্রশাসনে আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য দূর করা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা আরও সময়ের ব্যাপার। বড় সাফল্য এটিই ব্যাংক দখল, আর্থিক খাতের টাকা লুট করার সাহস এখন কেউ দেখাচ্ছে না এবং কাউকে সেই সুযোগও কাউকে দেয়া হচ্ছে না।
তবে সামগ্রিকভাবে সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ দুটি – নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং দেশব্যাপী অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। পোশাক খাতসহ বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের সংখ্যা কমে এলেও একেবারে থেমে গেছে বলা যাবে না। এদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। নির্মাণ খাত, আবাসন খাতসহ সামগ্রিক ব্যবসা বাণিজ্যে গতি ফিরিয়ে আনতে পারলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের অনুযোগটা অনেকটাই কমে আসবে। তবে পণ্য বাজারে যে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আছে তার বিরুদ্ধের কোন অবস্থাতেই নমনীয় হলে চলবে না যা দেশের মানুষ সাম্প্রতিক ভোজ্যতেল সংকটের সময় দেখেছে। ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে বাজারে তেলের ক্রত্রিম সংকট তৈরি করে সরকারের মাধ্যমে দাম বাড়িয়েও বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক করেনি।
সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সব মানুষই উদ্বিগ্ন। ছিনতাই রাহাজানি বাড়ছে। হত্যা বাড়ছে, দখল বাড়ছে। বাংলাদেশের রাজনীতি বহু দিন যাবৎ সহিংসতা কেন্দ্রিক। গত ১৫ বছর এই পেশিশক্তির রাজনীতি করেছে শাসক আওয়ামী লীগ। ওদের বিদায়ের পর নতুন একটি পক্ষ এখন চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, দখল ও আধিপত্য কায়েমের নামে মানুষকে নিপীড়ন করছে। কঠোর হাতে এই সহিংসতার চর্চা বন্ধ করার দাবি সর্বত্র।
সংস্কার না নির্বাচন – তা নিয়ে বিতর্ক আর আলোচনা থামছেই না। সরকারের অবস্থান হলো আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। তবে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। গত শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'ঐক্যবিহীন সংস্কার বা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না'। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে একই অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যতো দেরি হবে, সমস্যা আরও বাড়বে। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, 'গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনই প্রধান ফটক। আমরা আশা করছি নতুন বছরে দ্রুতই সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে একটি পরিষ্কার ধারণা জনগণ পাবে'।
এতসব জটিল অংকের মাঝেও নতুন বছরকে সামনে রেখে বিভিন্ন স্থাপনা আলোয় সাজিয়ে,বাজি পুড়িয়ে,পথ-ঘাট আলোয় ভরে তুলে পুরনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে মানুষ যেন কালো ও নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। নতুন বছরে নতুন প্রতিজ্ঞা বাংলাদেশের মানুষের সমাজ শিল্পায়িত ও বিশ্বায়িত হতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজ বিদ্বেষে পূর্ণ করে বিভাজিত করে রাখা হয়েছে। এবং কাজটি করেছে রাজনীতিকরা। এই জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার ত্যাগে যে নতুন বাস্তব আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে সেখানে ঐক্যই বেশি উচ্চারিত শব্দ। তাই সামাজিক চেতনা ও চিন্তার অনুশীলনে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশ্ন হল, সেই পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হবে যে, রাষ্ট্রীয় এবং সরকার পরিচালনার প্রতিটি স্তর থেকে প্রতিহিংসা চর্চা বন্ধ করার ভাবনা আসা প্রয়োজন। সমাজ সংস্কৃতির নানা পরিসরে নতুন ভাবনা এবং নতুন সৃষ্টির যে সব উদ্যোগ জারি রয়েছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম যে উদ্যোগে শামিল হয়েছেন, তাদের মধ্যে থেকেই উঠে আসতে পারে নতুন বছরের, এবং নতুন যুগের, উত্তরণের পথ।
লেখক: সাংবাদিক