কেমন শিক্ষব্যবস্থা চাই?
বাংলাদেশের শিক্ষানীতি নিয়ে টানা হেঁচড়া এপর্যন্ত কম হয়নি। একজন শিক্ষক হয়েও সেসব শিক্ষানীতি নিয়ে আমার পড়ালেখা তেমন একটা হয়নি, কিন্তু দুইযুগের বেশি সময় শিক্ষকতায় পার করায় এখন মনে হয় এটা নিয়ে নিজের চিন্তাভাবনা শেয়ার করা একটা দায়বদ্ধতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের দেশে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নমুখী শিক্ষা নিয়ে।
এখানে জাতীয় শিক্ষাক্রমের অধীনে বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা প্রচলিত আছে। ইংরেজি মাধ্যমে বিট্রিশ কারিকুলাম, আমেরিকান কারিকুলাম ইত্যাদি। উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্তের ছেলে মেয়েদের অধিকাংশরাই ব্রিটিশ বা আমেরিকান কারিকুলাম স্কুল, কলেজে ও লেভেল, এ লেভেল শেষ করে অনেকেই দেশের বাইরে পড়তে যায় বা দেশের মধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে। মধ্যবিত্তদের বেশিরভাগই থাকে ডিলেমার মধ্যে কিছু অংশ জাতীয় পাঠক্রমের বাংলা ভার্সনে কিছু অংশ ইদানীং ইংরেজি ভার্সনে, আর বাকিরা ব্রিটিশ বা আমেরিকান কারিকুলামে।
মধ্যবিত্তদের একেবারে সামান্যতম অংশ মাদ্রাসা শিক্ষায় যায়। নিম্নবিত্ত বা এরও নিচের বেশ কিছু অংশের ছেলে মেয়েরা বা ধর্মীয় আদর্শে বেড়ে উঠা পরিবারগুলোর কিছু ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসা শিক্ষায় যায়। এক্ষেত্রেও মেয়েদের সংখ্যা খুব কম একটা বেশি না। এ শ্রেশির আবার বেশ কিছু অংশে কারিগরী শিক্ষায় যায়। এক্ষেত্রেও মেয়েদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। এ শ্রেণির আবার বেশ কিছু অংশ কারিগরী শিক্ষায় যায়। একমুখী বা একই মানের, একই ভার্সানের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা কখনোই হয়তো সম্ভব না। ধর্মীয় ভাবাবেগের কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা যেমন বন্ধ করা যাবে না তেমনি উচ্চবিত্তদের বিরোধিতায় বিদেশি কারিকুলামের শিক্ষাব্যবস্থা ও বন্ধ করা যাবে না হয়তো। অন্যদিকে ইংরেজিতে দক্ষতার জন্য ইংরেজি ভার্সানের শিক্ষা পদ্ধতিরও গুরুত্ব কম না। কিন্তু যে বিষয়গুলোতে নজর দেয়া প্রয়োজন তা হলে, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টমশ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাদ দিয়ে অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা বা জে এস সি বহাল রাখা। দেশের প্রথমিক বিদ্যালয়গুলোকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আদৌ কোন গুরুত্ব আছে কি না ভেবে দেখা জরুরি, প্রাথমিক শিক্ষা বা পঞ্চম শ্রেণি পাসের সনদ নিয়ে কোন চাকরির আবেদন করার কোন সুযোগ আপাতত বাংলাদেশে নেই। সবার জন্য অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। পঞ্চম শ্রেণির কোমলমতি বাচ্চাদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ঠেলে দিয়ে তাদের মনে এই বয়সে পরীক্ষার ভীতি ডুকিয়ে দেয়ার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা কেবলমাত্র সরকারের একটা বিশাল খরচ, কোচিং সেন্টারগুলোর বাণিজ্য আর অভিভাবকদের বাচ্চাদের নিয়ে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে টানা হেঁচড়া করে জিপিএ ফাইভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই না। এটি অনতিবিলম্বে বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
অস্টম শ্রেণি বা জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যারা মানসম্মত জিপিএ পাবে না (ধরা যাক জিপিএ-৩) তারা মাধ্যমিক বিদ্যালয় তথা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। নবম, দশমকে মাধ্যমিক এবং একাদশ দ্বাদশকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা হিসাবে বহাল রেখে মাধ্যমিক স্কুল গুলোকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত করা যায়। এখন যেটা জরুরি হয়ে পড়েছে কারিগরী শিক্ষা এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা। এখানে আরো অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি উপজেলা শহরে একটি সরকারি কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন অত্যাবশকীয় হয়ে পড়েছে। যেখানে টেলিভিশন মেরামত, গাড়ি মেরামত, এসি মেরামত, পেইন্টিং এর কাজ, সেলাই কাজ, খুচরা বিক্রেতার কাজ, ড্রাইভিং সেলুনের কাজ, এক্সরে মেশিন চালানো থেকে শুরু করে বহুমুখী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থাকবে যা হবে দুই বছর মেয়াদী। যারা অস্টম শ্রেণিতে প্রত্যাশিত জিপিএ (জিপিএ-৩) পাবে না তাদের অনেকে হয়তো প্রশিক্ষণ বিহীন বা স্বল্প প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে ডুকে যেতে পারে। প্রশিক্ষণহীন মানে যে সমস্ত চাকরির জন্য নূন্যতম প্রশিক্ষণ লাগে না, যেমন পিয়ন, দারোয়ান, ইত্যাদি। আর বাকিরা যাদের রেজাল্ট জিপিএ-৩ এর নিচে তাদের নবম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ না দিয়ে পড়তে চাইলে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পছন্দানুযায়ী বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়ে যাবে। ওখানে দুই বছরের প্রশিক্ষণ শেষে যাদের ফলাফল আবার জিপিএ-৩ এর নিচে থাকবে তারা যার যার প্রশিক্ষিত বিষয়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরিরতে ডুকে যাবে। এক্ষেত্রে মোটর ওয়ার্কশপ থেকে শুরু করে অন্যান্য যে কোন ক্ষেত্রে এই প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীকে অধিকতর সুযোগ দেয় হবে। সরকারি বেসরকারি সবধরনের চাকরিতে এমনকি বিদেশে শ্রমিক রপ্তানিতে এই প্রশিক্ষিত কর্মীদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে। বিদেশ থেকে আমাদের রেমিটন্স এর প্রবাহ ও অনেক গুণ বেড়ে যাবে। যারা কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জিপিএ- ৩ বা তার ওপরে গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হবে তারা ভর্তি হবে পলিটেকনিক কলেজে, নার্সিং ইনস্টিটিউট, নয়তো স্বাস্থ্য বিভাগের ডিপ্লোমা কোর্সে যা হবে চার বছর মেয়াদী। চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করে তাদের অধিকাংশই চাকরির বাজারে ডুকতে পারবে এমনকি বিদেশের শ্রমবাজারেও তাদের চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে অষ্টম শ্রেণি পাস করে পরিবারের প্রয়োজনে অনেকে চাকরিতে, আবার দ্বিতীয় ধাপে দুইবছর পরে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে আরো দুই বছরে পরে (যেটিকে এস.এস.সি সমমর্যাদা দেয়া যায়) বেশ কিছু অংশ শ্রমবাজারে এবং তৃতীয় ধাপে আরো চার বছর পরে আরো বড় একটি অংশ শ্রম বাজারে ডুকে যাবে। একদিকে পরিবারের বোঝা না হয়ে পরিবারের উপার্জন সক্ষম হবে, বেকার না থেকে দেশের অর্থনীতিকে সচল করবে বিদেশের শ্রমবাজারে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে রেমিটেন্সও অনেকগুণ বাড়বে। প্রয়োজন হবে দেশের প্রতিটি উপজেলা শহরে পলিটেকনিক কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্যবিষয়ে ডিপ্লোমার জন্য সরকারি ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে।
অন্যদিকে যারা অস্টম শ্রেণিতে জিপিএ-তে বা তার অধিক গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে তারা নবম শ্রেণিতে ভর্তি হবে, এক্ষেত্রে নবম এবং দশম শ্রেণিতে একমুখী শিক্ষা (বিজ্ঞান: বাণিজ্য সমাজ বিজ্ঞান এবং মানবিক শিক্ষা এককরে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিয়ে) চালু করা প্রয়োজন। পরবর্তীতে যারা এসএসসি জিপিএ-৩ এর নিচে গ্রেড পাবে তারা ভর্তি হতে পারবে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। আর যারা জিপিএ-৩ বা তার উপরে গ্রেড পাবে তারা ভর্তি হবে একাদশ শ্রেণিতে, যেখানে গিয়ে তারা বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সমাজবিজ্ঞান বা মানবিক বিষয়গুলোতে অধ্যায়ন করবে এ ক্ষেত্রে ও মানবিক ও সমাজ-বিজ্ঞান আলাদা না রেখে, এক করে ফেলা যায়। এইচ.এস.সি ফলাফলে ও যার জিপিএ-৩ এর নিচে গ্রেড পাবে তার বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা হারাবে। তারা কলেজ গুলোতে ৩ বছরের পাস কোর্সে ভর্তি হবে অথবা সর্বাধিক দুই বছরের রেয়াত নিয়ে পলিটেকনিক, নার্সিং বা স্বাস্থ্য সহকারীর ইনস্টিটিউটে ভর্তি হবে।
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যাজুয়েশন শেষে যাদের রেজাল্ট পিপিএ-৩ এর নিচে থাকবে তারা কোনভাবেই আর পোস্ট-গ্যাজুয়েশন করতে পারবে না (এক্ষেত্রে জিপিএ-৩ কে আমি একটা স্টান্ডার্ড হিসেবে ধরেছি এটা আরো বেশি রাখা যায়)। শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তনগুলো নীতি নির্ধারক মহল ভেবে দেখতে পারেন। আমাদের দেশে বর্তমানে একটার পর একটা সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা অনুমোদন না দিয়ে, দেশের প্রতিটি জেলা শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ এবং প্রকৌশল কলেজ প্রতিষ্ঠা অনেক বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বিদেশের বাজারে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে এধরনের গ্যাজুয়েটদের কদর অনেক বেশি। তাছাড়া আমাদের দেশেও এখনো চিকিৎসক সংকট প্রচুর। বর্তমানে যে ধারাটি প্রচলিত আছে তাতে আমরা আমাদের অনেক ছেলেমেয়েদের ঠেলেঠুলে ধাক্কা দিতে দিতে উপরে তুলে দিচ্ছি। গ্র্যাজুয়েট, পোষ্ট- গ্র্যাজুয়েট বানিয়ে বেকারত্বের হতাশায় ঠেলে দিচ্ছি। যা পক্ষান্তরে দেশের জন্য ক্ষতি, পরিবারের বোঝা এবং সর্বোপরি দেশের বোঝা। যে ছেলে মেয়েটি ভালো রেজাল্ট নিয়ে এসএসসি পাস করার মতো মেধাশক্তি নেই তাকে হয়তো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নয়তো বিবিএ, এমবিএ বানাচ্ছি। পরবর্তীতে তারা কর্মজীবন সফলতা পাচ্ছে না। সবাইকে সৃষ্টিকর্তা একই মেধাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করে না। কেউ হয়তো ভালো গায়ক, কেউ পেইন্টার, কেউ বা ভালো খেলোয়াড় হতে পারে। আমরা তা না করে জোর করে সবাইকে গ্র্যাজুয়েট পোষ্ট- গ্র্যাজুয়েট বানাতে চাই। সমাজের মানুষের মন মানসিকতার যেমন একটা আমুল পরিবর্তন দরকার তেমনি শিক্ষানীতিমালারও একটা পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। না হলে জাতি হিসেবে আমরা আরো পিছিয়ে যেতে পারি দিনে দিনে।
লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।