পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে সংকট
১৯৭৬ সালের ১৬ আগস্ট মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই নামে পরিচিত। একটি দেশের অর্থনীতি পুঁজিবাজারের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। পুঁজিবাজার উন্নত হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বাড়ে। শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই। শিল্পায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সরবরাহে পুঁজিবাজার বড় অবদান রাখে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন সূচকেরও উন্নতি ঘটে। দেশের সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক গতিবিধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জনগণের অর্থনৈতিক জ্ঞান ও সরকারি নীতিমালা পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করে। দীর্ঘ ৪৮ বছরেও দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।
উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ না করে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি করা হয়। কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের সুবিধা হচ্ছে বছর শেষে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কেবল মুনাফা করতে পারলেই বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ড দেবে। আর ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে মুনাফা হোক আর না-ই হোক সুদসমেত ঋণের কিস্তি ফেরত দিতে হয়। আমাদের মতো দেশে আরো একটি জটিল সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ সময়ই গৃহীত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলেও ব্যাংকের ঋণ সুদসহ ঠিকই ফেরত দিতে হয়। বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত করতে হলে আগামী দিনগুলোতে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের প্রচুর পুঁজির প্রয়োজন হবে। ব্যাংকিং খাত সেই পুঁজির জোগান দিতে পারবে না। তাই আমাদের পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই হবে।
দেশের ব্যক্তি খাতে যে-সব বড় বড় কোম্পানি আছে তাদের পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পুঁজিবাজারের সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হলে বাজারে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের জোগান বৃদ্ধি ব্যতীত গত্যন্তর নেই।
বিভিন্ন শ্রেণীর বিনিয়োগকারী বিশেষ করে যারা স্বল্পপুঁজির তাদের পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আসেন না। যে কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন সেটা বিনিয়োগযোগ্য কিনা তা প্রথমে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সেই মানের বিনিয়োগকারী তৈরি হয়নি। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে তারা কোম্পানি নির্বাচনের ব্যাপারে সতর্ক হতে পারে। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলে পুঁজিবাজার বিকাশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মার্কেটে বিনিয়োগ করা মানেই দ্রুত মুনাফা করে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হওয়া যায়-এই ধারণা নিয়েই অধিকাংশ বিনিয়োগকারী এখানে আসেন। বাজারে এসেই তারা নানা গুজবের উপর নির্ভর করে বিনিয়োগ শুরু করেন। ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিবর্তে দুর্বল মৌলভিত্তির যে-সব কোম্পানির শেয়ার নিয়ে নিয়মিত কারসাজি হয় সেগুলোতে আস্থা রাখেন এবং গুজবের পেছনে ছুটতে থাকেন। অল্পদিনেই পুঁজি হারিয়ে লোকসানের কবলে পড়েন। তারপর একরাশ হতাশা নিয়ে পুঁজিবাজারকে গালিগালাজ করে বাজার থেকে বিদায় নেন। যতটা উৎসাহ নিয়ে বিনিয়োগ করতে এসেছিলেন,ঠিক ততটাই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পুঁজিবাজারের প্রতি উৎসাহ হারান। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে,যারা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবেন তাদের আগে থেকেই বাজারের স্বভাব এবং গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজার সম্পর্কে মৌলিক এবং প্রাথমিক ধারণা না থাকলে এখানে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
উন্নত দেশগুলো পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে তাদের অর্থনীতিকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে এখনো পুঁজিবাজারকে আর্কষণীয় করা যায়নি। বহুজাতিক বেশিরভাগ কোম্পানি এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি। এসব কোম্পানি বাজারে আসলে ভালো শেয়ারের সংকট অনেকখানি দূর হবে। দেশের ভালো ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার পাশাপাশি বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের ভালো লভ্যাংশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের পুঁজির নিশ্চয়তা দিতে হবে। গুজব নির্ভর বিনিয়োগের ব্যাপারে বিনিয়ো্গকারীদের সচেতন হতে হবে। তাহলেই পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গায় পরিণত হবে। পুঁজিবাজার থেকে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নও সম্ভব হবে।
গণমাধ্যমকর্মী