আত্মহত্যা কেন?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে এক ছাত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর প্রতীক তারামন বিবি হলের ৭০০৫ নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। এই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৫৩তম ব্যাচের (২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী ছিলেন। মেয়েটি তার প্রেমিকের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে তাকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।
আত্মহননের ঘটনা বাড়ছে। নানা সংকট, নানা জটিলতায় মানুষ এটা করছেন। দু'একটি ঘটনা যখন আলোচনায় আসে,তখন আমরা দেখি কিছু কারণের কথা বলা হচ্ছে,সেই মানুষটাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য কিছু মানুষের ভূমিকার কথা উঠে আসছে।
তাই আত্মহত্যার ঘটনা কেবলই কোনও নিভৃত কাণ্ড নয়। নিজেকে খুন করছেন মানেই হলো তারা আর এ সমাজে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছেন না। আইনে প্ররোচনার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপরে। মৃত যদি সুইসাইড নোটে কাউকে দায়ী করে যান,তার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা হতে পারে। তা না হলে পুলিশ দেখবে,কারও কথা বা আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষটি এই রাস্তা বেছে নিয়েছেন কিনা। কিন্তু সেই তদন্তটা জোরালোভাবে হয় না তেমন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত কয়েক বছরে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যা করছেন। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কেন হয়,তা জাতীয়ভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ইদানীং পড়ালেখা ও ফলাফল নিয়ে আগের চাইতে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। পড়াশোনা এখন পরিণত হয়েছে অস্থির সামাজিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে মা-বাবা সন্তানের পরীক্ষার ফলকে সামাজিক সম্মান রক্ষার হাতিয়ার বলে মনে করেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে একটা ছেলে বা মেয়ে যখন ভাবে পড়ালেখা শেষ করে কী করবে,তখন রাজ্যের হতাশা তাকে ডুবিয়ে দিতে থাকে।
আমাদের নগরায়ণ বাড়ছে। ছোট শহর বড় হয়ে যাচ্ছে,বড় শহর মেগাসিটি হচ্ছে। গ্রামেও নগরায়ণের ছোঁয়ায় পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বদলে যাচ্ছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত – আমরা জীবনযাপন করছি শহুরে অমানবিকতায়। যারা নিজেদের প্রাণটি নিজেরাই কেড়ে নেওয়ার মতো চরম দুঃসাহসিক কাজটি সমাধা করেছেন,তাদের কোথায় বেদনা ছিল কেউ জানবে না।
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? কী এমন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে একজন মানুষ? কোন কারণে হতাশ বা অত্যাচারিত হতে হতে যখন কোনো মানুষ এমন একটা পর্যায় পৌঁছায়, যে অত্যাচারের প্রতিকার পাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না,তখন অনেকে আত্মাহুতি দিয়ে ফেলেন। মানসিক চাপ,হতাশা,অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে কেউ কেউ ভাবেন আত্মহত্যা করলে সব সমস্যার সমাধান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী আত্মহত্যা করলেন তার পরিবার বা বন্ধুরা কী জানতো তার কষ্ট কোথায় ছিল? কেমন ছিল? তিনি তো আমাদের মতোই স্বাভাবিক ছিলেন। তার ভালোবাসা ছিল তিক্ততা ছিল,বই পড়া,টিভি দেখা,সামাজিকতা করা,সবই ছিল। তাহলে হঠাৎ তার মনে এমন কী জেগে উঠলো যে নিজেকে তিনি এই পৃথিবী থেকে,সব প্রিয়জন থেকে সরিয়ে নিলেন? জীবনটাকে কতটা ফাঁপা তেতো বোঝা মনে হলে এই জীবন থেকে এমন জোরপূর্বক ছুটি নেওয়া যায়?
আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগ আছে কিনা সেটাও ভেবে দেখা দরকার। আত্মহত্যার প্রবণতা বোধহয় কয়েকগুণ বেড়েছে অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে। বেকার যুবক,কর্মচ্যুত শ্রমিক — অনেকেই হয়তো বেছে নিচ্ছেন এই অন্তিম পথ। সাথে আছে প্রেমের জটিলতা, পারিবারিক সমস্যা।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর সবাই গুরুত্বারোপ করেন। কিন্তু কীভাবে? সমাজে অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়। আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন,সক্ষম ও আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে হবে।
আমাদের চারপাশে অনেক হতাশা ও অবসাদ আক্রান্ত মানুষ দেখি। তাদের বোধ,তাদের উপলব্ধি আমরা বুঝতে চাই কম। তারা হয়তো আত্মহননের কথা কখনও কখনও বলেও ফেলেন। কিন্তু আমাদের কাছে সব সময় এমন যুক্তি থাকে না,যা দিয়ে তার চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা ঠেকাতে পারি। স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে কাছে টেনে নেওয়ার এই ভাবনাটা নিয়ে ভাবা দরকার। অবসাদের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে অনেকে মনে করেন যে আর কোনও দরজাই খোলা নেই। আত্মহত্যার কথা মাথায় এলে জীবনের ইতিবাচক দিকগুলো দেখা প্রয়োজন আর সে রকম উদ্যোগ সামাজিকভাবেই প্রত্যাশিত। প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও সহমর্মিতা।
লেখক: সাংবাদিক