বাঙালি রুগ্ন জনগোষ্ঠী
সবকিছুতে ব্যতিক্রম থাকে। ব্যতিক্রম-ব্যতিক্রমই, ব্যতিক্রম যুক্তি হতে পারে না। ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক কুলদি নায়ার বলেছেন, 'একটি কোকিল ডাকা মানে বসন্ত নয়, ব্যতিক্রম যুক্তি নয়।' ব্যতিক্রম নিয়ে আমরা তর্ক করি। কোনটা তর্ক, কোনটা বিতর্ক আর কোনটা কুতর্ক তার পার্থক্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই। বঙ্কিম চন্দ্র অনেক আগেই বলে গেছে, 'বাঙালিরা বিতর্ক জানে না, কুতর্ক জানে'। আমরা যা জানি বা বিশ্বাস করি তা চরম সত্য মনে করি। আমার চিন্তার বাইরেও সত্য থাকতে পারে না মানতে রাজি নই। এটি আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। কখন বুঝবেন আপনি জ্ঞানী হয়ে উঠছেন, যখন আপনার মনে ধারণা জন্মাবে, আমি যা জানি তা খুবই সামান্য জ্ঞান। আমি যা জানি তা সত্য নাও হতে পারে। নতুন সত্যের সন্ধান আমি পেতে পারি। আমি যার সাথে বিতর্ক করছি সে বিতর্কে আমার বিষয়টি সত্য নাও হতে পারে। আমার বিপরীত মতের ব্যক্তির মতটি সত্য হতে পারে। একই সাথে দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে দুটিই সত্য হতে পারে। এসব ধারণা যার মনে জন্মাবে বুঝতে হবে সে জ্ঞানী হয়ে উঠছে। এসব ধারণার বিপরীত বিশ্বাসী জ্ঞানী নন।
সবকিছু পরিবর্তনশীল। 'পরিবর্তন' ছাড়া আর কিছুই স্থায়ী নয়। রবীন্দ্রনাথের নিকট একবার প্রশ্ন করা হলো, আপনি মাইকেল মধুসুদন দত্তের সমালোচনা করছিলেন, এখন আবার প্রশংসা করছেন কেন? উত্তরে তিনি জানালেন, আমি এখন পঁচিশ বছরের যুবক? আমার বয়স পঁচাত্তর বছর। আমার বয়স বেড়েছে, পরিপক্বতা বেড়েছে। কাঁচা আমের রস যেন অম্ল রস, কাঁচা সমালোচনাও গালি গালাজ'। মানুষের বয়সের সাথে সাথে মত পথ কথা পরিবর্তন করতে হয়। কখন কোথায়, কোন স্থানে পবিবর্তন করবে, না করবে তা বুঝতে হয়, জানতে হয়। অবলা এক নারী প্রতি বছর পঁচিশ শত জন্মদিন পালন করতো। তার নিকট জানতে চাইলো, আপনার প্রতি বছর কী করে পঁচিশতম জন্মদিন হয়? অবলা নারী জানালো, বাবা আমি এক কথায় মানুষ, বছর বছর আমি কথা পাল্টাতে পারবো না। সময়ের সাথে কথা পাল্টাতে হয় তা সে নারী বুঝতে চাইতো না। রবীন্দ্রনাথের নিকট জানতে চেয়েছিল, আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী? তিনি জানালেন, আমার 'স্ববিরোধীতা'। আবার তাঁর নিকট জানতে চাইলেন, আপনার সবচেয়ে বড় দোষ কী? তিনি জানালেন, আমার 'স্ববিরোধীতা'। একটি বিষয় দোষ ও গুণ কী করে হয়। এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, 'আমার চিন্তা- চেতনার গতিশীলতার কারণে দিনে দিনে বাতিল করে নতুন সত্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এটি আমার বড় গুণ। আর একজন ব্যক্তি দুই ধরনের কথা বলছি, এটি আমার বড় দোষ। মহামনীষীদের ভুল থাকে। ব্যর্থ রচনা জগৎ লেখক সেক্সপিয়ার রবীন্দ্র-নজরুলের ছিল। ব্যর্থতার মধ্যে সফলতার জন্ম হয়। বাল্যশিক্ষা হতে রবীন্দ্র-নজরুল রচনার মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু রবীন্দ্র-নজরুল পড়তে চাইলে আগে বাল্যশিক্ষা পড়ে আসতে হয়। দুধের চেয়ে মাখনের দাম অনেক বেশি। কিন্তু। দুধ ছাড়া মাখন হয় না। ব্যর্থ রচনার পথ ধরেই সফল রচনার জন্য হয়। বাঙালি ভুলটাই দেখে, দোষটাই দেখে। অধিকাংশ বাঙালি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি একটি রোগ। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, 'বাঙালি একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠী'।
আলোক দর্শন
মাও সেতুং বলেছেন, '৭০ ভাগ গুণ থাকলে ভালো মানুষ'। আমরা নবী-রাসুল বা ফেরেস্তা নই। আমাদের ৩০ ভাগ দোষ থাকতে পারে। ৭০ ভাগ গুণের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ৩০ ভাগ দোষের দিকে দৃষ্টিপাত করা বাঙালির নেতিবাচক চরিত্র। পূর্ণাঙ্গ মানুষ বিচারের ক্ষমতা বাঙালি কখনো অর্জন করতে পারেনি। প্রত্যেক বাঙালি নিজের বেলায় আইনজীবী আর পরের বেলায় বিচারক। নিজের দোষ দেখি না। পরের দোষ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে আনন্দ পাই। হযরত ওমর ফারুক (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এক চোখ দিয়ে নিজের দোষ দেখেন, অন্য চোখ দিয়ে পরের গুণ দেখে সেই শ্রেষ্ঠ বিচারক। বাঙালি কখনো নিজকে বিচার করতে পারে না। বাঙালি কোনো মনীষী আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখতে সক্ষম হয়নি। কারণ
কারো জীবনের অন্ধকার দিক আত্মজীবনীতে তুলে ধরতে পারেনি। তাই হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, 'বাঙালির আত্মজীবনী শয়তানের মুখে ফেরেস্তার ডায়েরি।' আবার পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী হজম করার ক্ষমতাও বাঙালির নেই। তাই সুনীল পঙ্গোপধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম দিয়েছেন 'অর্ধেক জীবন' হয়তো বাকি অর্ধেক বাঙালি হজম করতে পারবে না, বদহজমের ভয়ে এই নামকরণ করেছেন। আমাদের পরের উন্নতি পছন্দ নয়। জন্মগতভাবে হিংসুক আমরা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার অনেক গুণ আছে, কিন্তু বাধা হলো তাদের 'পরশ্রীকাতরতা'। এই দোষ হতে বাঙালি কোনদিন মুক্ত হতে পারবে না।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,'পরশ্রীকাতরতা' শব্দটি দুনিয়ার কোথা নেই, বাঙালির আছে। আমর জানি, আমরা আহার করি নিজের জন্য আর জামা কাপড় পরি অপরের জন্য। আমার জামা কাপড়ের সৌন্দর্য আমি উপভোগ করি না, অন্যরা উপভোগ করেন। অপরের উপভোগের জন্য ভালো জামা কাপড় যতই পরেন, বাঙালি হলে এসব ভালো পছন্দ করে না। উন্নত দেশের মানুষের সামনে আপনি যদি ভালো পোশাক আশাক পরে যান তখন তারা মনের আনন্দে বলেন, 'লুকিং ভেরি নাইচ' দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে কিন্তু বাঙালির চরিত্র তার বিপরীত। কারণ বাঙালির বড় রোগ তার নেতিবাচকতা আমরা সবাই আমাদের কর্মের স্বীকৃতি চাই। কিন্তু অন্যের কর্মের স্বীকৃতি দিতে চাই না। আমি যদি অন্যের কর্মের স্বীকৃতি না দেই তাহলে আমার কর্মের স্বীকৃতি চাওয়ার অধিকার থাকে কী করে! একটি গল্প দিয়ে আজকের লেখাটির ইতি টানতে চাই। এবা গ্রামের এক লোক জীবনে কাউকে স্বীকৃতি দেয়নি। তার মুখে একটি ইতিবাচক কথা কেউ বের করতে পারেনি। সবার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন এবং নেতিবাচক কথা বলতো। একদিন তার বন্ধুরা বসে সিদ্ধান্ত নিল এই ব্যক্তির মুখে একটি প্রশংসামূলক ইতিবাচক কথা বের করবেই। তার জন্য কী করা যায় সবাই ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, এক জায়গায় একটি দারুণ প্রশিক্ষিত কুকুর পাওয়া যায় যে কুকুরটি পানি ওপর ছেড়ে দিলে, কুকুরটি পানির উপর হেঁটে চলে যেতে পারে সব বন্ধুরা কুকুরটি এনে পুকুরে ছেড়ে দেবে আর কুকুরটি পানির উপর হেঁটে চলে যাবে। বন্ধুরা এই দৃশ্য দেখে সবাই হাততালি দিয়ে প্রশংসা করে বলবে 'বাহ বাহ এমন প্রশিক্ষিত কুকুর দুনিয়াতে নেই'। তখন নেতিবাচক ব্যক্তিটিও বলতে পারে 'হুমত ভালো প্রশিক্ষিত কুকুর'। তখন একটি ইতিবাচক কথা তার জবান হতে পাওয়া যাবে। যেমন কথা তেমন কাজ। প্রশিক্ষিত কুকুরটি এনে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হলো কুকুরটি পানির উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে, তখন সবাই হাত তালি দিয়ে কুকুরটির প্রশংসা করছে কিন্তু নেতিবাচক লোকটি একদম চুপ। সবাই তার নিকট প্রশ্ন করলেন বন্ধু! এই প্রশিক্ষিত দারুণ কুকুরটির একটু প্রশংসা করবি না? সে জবাব দিল, প্রশংসা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল, হায়রে কুকুরটি সাঁতার জানে না। সাঁতার জানলে কুকুরটি হেঁটে যেতো না। যার রক্তে মাংসে নেতিবাচকতার বীজ লুকায়িত, তাকে ইতিবাচক করা সত্যি কঠিন। আশা কবি গল্পের মর্মার্থ আত্মস্থ করতে পারবেন। পরিশেষে যে কথাটি উচ্চারণ করার লোভ সামলাতে পারলাম না, সেটি প্রশংসা করার জন্য লাগে মানুষের ভালো কাজের স্বীকৃতি ও হৃদয় আর সমালোচনার জন্য জিহ্বাটাই যথেষ্ট।
লেখক: কলাম লেখক, রাজনীতিবিদ