চিকিৎসায় ভারত মুখাপেক্ষী না থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার এখনই সময়
ভারতের সাথে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে পশ্চিমবঙ্গের অনেক হাসপাতাল ও চিকিৎসক বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসা দিবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশে এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নানা প্রকার মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে। তবে একটি সাধারণ কথা সবাই বলছে যে,বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত উন্নয়নের এখনই সময় যেন সাধারণ মানুষকে কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে বাইরে যেতে না হয়। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে পারলেও সাধারণ মানুষের ভরসা ভারত। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক অসুস্থ মানুষ,যারা চিকিৎসার জন্য ভারতে যান, যাদের চিকিৎসা চলমান যেমন কেমো,রেডিয়েশন থেরাপি,অস্ত্রোপচারের আশু প্রয়োজনীয়তা,ক্যানসার অপসারণের ফলো-আপ,অর্গান প্রতিস্থাপন,ইত্যাদি জরুরি চিকিৎসা যাদের প্রয়োজন তারা বেশ জটিল সমস্যার সম্মুখীন।
ভারতের উপর এই নির্ভরতা আমাদের কমিয়ে আনতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? আমরা দেখি এমন মানুষ আছেন যারা সামান্য জ্বর সর্দিতেও দেশের বাইরে চলে যান। এতটাই আস্থাহীনতায় ভুগছে আমাদের স্বাস্থ্যখাত। বিগত সরকারের আমলে আমরা দেখেছি রুটিন চেক আপের জন্য বিরাট দলবল নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রপতি চলে যেতেন ইউরোপে। যে দেশের রাষ্ট্রপতি শরীরের সামান্য রুটিন চেক আপে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারেন না সে দেশের স্বাস্থ্যখাত জন- আস্থা পাবে কীভাবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতে এখন সেখানে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যচিত্রটি বেশ জটিল। মফস্বলতো আছেই,রাজধানী ঢাকার যে কোনও সরকারি হাসপাতালে গেলেই তা বোঝা যায়। রোগীর তুলনায় শয্যার অপ্রতুলতা এবং চিকিৎসকদের অভাব সাধারণ চিত্র। সমস্যা আছে হাসপাতাল প্রশাসনের সঙ্গে চিকিৎসক,রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের যা মাঝেমধ্যেই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শৃঙ্খলাহীনতা জানিয়ে দেয়। অথচ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত আমাদের সরকারি স্বাস্থ্য কাঠামো বিস্তৃত যা ভারতে শুধু নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় আর নেই।
অদ্ভুত সব কান্ড শোনা যায় প্রায়ই। বেঁচে থাকা রোগীকে মৃত ঘোষণা দেয়া, খারাপ চোখ রেখে ভাল চোখে অপারনেশন করে ফেলা, হাত-পা কেটে ফেলা, অপারেশনের পর গজ, তুলা শরীরে রেখে দিয়েই সেলাই করে ফেলা, রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর সাথে মিলে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার নামে ডাক্তারদের অতিরিক্ত কমিশন বানিজ্য করা, ঔষুধ কোম্পানি থেকে আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দেওয়া সহ অসংখ্য অভিযোগ জমা আছে মানুষের কাছে। ভুল এবং অপ-চিকিৎসার অভিযোগের কোন শেষ নেই। সরকারি হাসপাতালের বাইরে এম্বুল্যান্স নৈরাজ্য, আয়া, নার্স, ব্রাদারসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের দুর্ব্যবহার এবং ইন্টার্ন ডাক্তারদের সহিংস আচরণ নিয়মিত খবরের বিষয়।
হাসপাতালগুলোতে সুস্থ অবকাঠামো আর পরিবেশের অনুপস্থিতি বড় বিষয়। এক্স-রে, ইসিজি,ইইজি,সিটি স্ক্যান ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ের জরুরি যন্ত্রপাতি অধিকাংশ হাসপাতালেই অকেজো থাকে,যার ফলে রোগীদের বাইরে থেকে এসব পরীক্ষা করিয়ে আনতে হয়। কিন্তু সিরিঞ্জ,সুচ,স্পিরিট বা গজ-তুলার মতো সামান্য উপকরণগুলোও প্রায়ই সরকারি হাসপাতালে মজুত থাকে না। বিগত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি ছিল বহুল আলোচিত এ বিষয়। শুধুই কেনাকাটা, অত্যন্ত্য ব্যয়বহুল সব যন্ত্রপাতি ও গাড়ি, এম্বল্যান্স। কিন্তু এগুলোর যৌক্তিক ব্যবহার হয়েছে খুবই কম।
ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সেবার সংকট আস্থার সংকটকে এতো তীব্র করেছে যে, প্রায়ই বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের হাতে চিকিৎসকরা নিগৃহীত হচ্ছেন। আর এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসকরা। স্বজনরা মারমুখী হন,কারণ,তারা চিকিৎসকদের ভরসায় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেবা পছন্দ না হলেই তাদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। প্রশ্ন হলো শুধু চিকিৎসকদের ওপরই কি সব নির্ভর করে? তারা কী দিয়ে চিকিৎসা করবেন,যদি তাদের কাছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সামগ্রী মজুত না থাকে? যদি হাসপাতালের বেডের চেয়ে রোগী অনেক বেশি হয়? যদি চরম অব্যবস্থা আর নৈরাজ্যই স্বাভাবিক হয়ে থাকে? রাজধানী সরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা যখন ভালো নয়,তখন জেলা,উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থা কী রূপ সেটা কল্পনা করতে কষ্ট হয় না। একদিকে সরঞ্জামের অভাব, অন্যদিকে মাসের পর মাস চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ক্রমেই সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।
ভৌত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি যথেষ্ট আছে। কিন্তু রোগীর চিকিৎসা করা সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে যে আন্তরিকতা দরকার তা নেই। শুধু যন্ত্র সব কাজ করতে পারে না। রাজধানীর বাইরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ডাক্তারদের হাজিরার করুণ চিত্র এবং রোগী দেখার আন্তরিকতার অভাব সবাই জানে। চিকিৎসা না পেয়ে গ্রামের রোগী শহরের হাসপাতালগুলোয় চাপ তৈরি করছে। যদি মানসিকতা না গড়ে ওঠে,তা হলে যতই হাসপাতাল,সরঞ্জাম,ডাক্তার সরকারি ব্যবস্থায় বাড়ানো হোক না কেন,তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সরকারি ব্যবস্থা যতই দুর্বল হচ্ছে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ক্রমশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলে যাচ্ছে। এবং তার পরিণতি হলো আনাচে কানাচে ক্লিনিক আর ডায়গনস্টিক ব্যবসা,যেখানে সেখানে যেমন তেমন হাসপাতাল আর সাধারণ মানুষের টাকার শ্রাদ্ধ। করপোরেট হাসপাতাল বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসেও নৈরাজ্যের আওয়াজ পাওয়া যায়। এতে করে চিকিৎসার মতো মহান পেশার মহত্ব আজ প্রশ্নের মুখে।
এই বাস্তবতাতেই আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে ভারতে আমাদের মানুষদের চিকিৎসা নিয়ে। চিকিৎসার জন্য বিদেশি হিসেবে ভারতে শীর্ষস্থানে বাংলাদেশিরাই। লাখ লাখ বাংলাদেশি প্রতিবছর সেখানে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। বিশেষ করে চেন্নাই; ব্যাঙ্গালোর এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তারা চিকিৎসার জন্য ছোটেন। ভিসা জটিলতা কমে যাওয়ায় অনেকে এখন সাধারণ রোগের জন্যও শিলিগুড়ি বা আগরতলায় চলে যান ডাক্তার দেখাতে।
ভারতেও যে ভুল চিকিৎসা হয় না তা নয়। এমনও হয়েছে বাংলাদেশের চিকিৎসকরা যা বলেছেন রোগীকে, ভারতে গিয়ে শোনেন একই পরামর্শ। তাহলে কেন যায় এত রোগী? বাংলাদেশি রোগীরা বলেন তারা ভারতীয় চিকিৎসকদের কাছে যতটা চিকিৎসা পান তার চেয়ে বেশি পান সান্ত্বনা,আন্তরিক পরামর্শ। ভারতীয় ডাক্তাররা রোগীকে সান্ত্বনা দিতে পারেন এবং ভালো ব্যবহার করেন, যা বাংলাদেশি ডাক্তারদের কাছে তারা পান না বলে অভিযোগ করেন। আরেকটা অভিযোগ,এখানকার ডাক্তাররা মনোযোগ সহকারে রোগী দেখেন না। সেটি সরকারি হাসপাতাল হোক আর বেসরকারি হাসপাতাল হোক- সর্বত্র একই চিত্র। সার্বিকভাবে বলতে গেলে বাংলাদেশি রোগীদের মধ্যে যারা ভারতে চিকিৎসা নেন, তাদের মতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা ব্যয়ও কম। এবং একইসাথে চিকিৎসাসেবা কয়েকগুণ ভালো এবং হাসপাতালগুলো পরিচ্ছন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল খুবই অপরিচ্ছন্ন থাকে।
বাংলাদেশি চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় অন্তরায় হচ্ছে মেডিকেল রিপোর্ট। বাংলাদেশে পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয় বলে প্রায় সব রোগীই অভিযোগ করেন। এর কারণ হলো যে ডাক্তার এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার কথা তিনি তা করেন না। রিপোর্ট দেওয়া হয় তার নামে, তার সিল থাকে, কিন্তু কাজটা করে একজন অনভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান। এটি যে বড় দুর্নীতি সেটা ডাক্তার মশাইরা নজরেও আনছেন না। এখানে যখন একজন রোগীকে বলা হচ্ছে অপারেশন করতে হবে তখন ভারতে গিয়ে সামান্য ওষুধে ভাল হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ এখানে ডায়াগনোসিস বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না।
আমাদের শুরুটা করতে হবে এখান থেকেই। সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। রোগী যে শ্রেণিরই হোক না কেন, ভাল ব্যবহার করতে হবে। ডায়াগনসি যথাযথ হতে হবে।
বাংলাদেশে চিকিৎসাখাতে বিনিয়োগ কম নেই। অনেক বিশেষায়িত হাসপাতালও গড়ে উঠেছে,কিন্তু চিকিৎসা সেবার মান বাড়ছে না। রোগীদের আস্থা তৈরি করতে হবে হাসপাতাল,ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর ডাক্তার-নার্সদের উপর। চিকিৎসা খাতে বিদেশ এবং বিশেষ করে ভারত মুখাপেক্ষী না থেকে আত্মনির্ভর হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
লেখক: সাংবাদিক