কোনটা বেশি দরকার? মানুষের আয় বাড়ানো, নাকি নিত্যপণ্যের দাম কমানো?
এখন চারদিকে একটাই বিষয়– দ্রব্যমূল্য। অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার সাধারণ মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। টেলিভিশন সংবাদে কিছু কিছু করে উঠে আসছে সাধারণ মানুষের কথা। এ সময় তাদের অসহায় মুখগুলো দেশজুড়ে বেদনার পরিবেশ তৈরি করছে। এক নারীকে দেখা গেল খুবই বিমর্ষভাবে বলছেন –'বাবা মুরগী কিনতে পারিনি,টাকায় কুলায়নি'। আরেক বৃদ্ধ বলছেন,'ভাত খেতেই পারছি না তো ডিম কেনার কথাই তো আসে না'।
খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে,এক সপ্তাহে,অর্থাৎ ৭ থেকে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে ১২টি নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এ তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল,পাম তেল,চালের কুঁড়ার তেল বা রাইস ব্র্যান অয়েল,আলু,ছোলা, পেঁয়াজ,রসুন,জিরা,দারুচিনি,ধনে,গরুর মাংস ও ডিম। ডিমের দাম নতুন করে বেড়েছে ডজনপ্রতি ১২ টাকা। এখন দাম উঠেছে ডজনপ্রতি ১৮০–২০০ টাকায়। দর কমাতে বাজারে অভিযান শুরুর পর ডিম বিক্রিই বন্ধ রেখেছে কিছু কিছু আড়ত। এতে সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক বাজারে ডিমই পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাজার এখন বেসামাল। তবে এটাও ঠিক যে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন বছর ধরেই অতি চড়া দ্রব্যমূল্য একটি বড় ইস্যূ হয়েছিল। বলা যায় গণঅভ্যুথ্যানে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল মূলত দুটি কারণে – একটি হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি এবং আরেকটি অবাধ দুর্নীতি ও লুটপাট।
করোনার পর অর্থাৎ,২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশে চাল,ডাল, পেঁয়াজসহ তেলের দাম ও অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তা নিয়ে নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। বিগত সরকার সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করাসহ বাজারে ভোক্তা অধিকার দপ্তরের অভিযান পরিচালনা করছিল। একই কাজ করছে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
তবে কী এ কথা বলা যায় যে,এই সরকার শেখ হাসিনার সরকারের মতোই ব্যবসায়ীদের সাথে পেরে উঠছে না? এই যে শুল্ক প্রত্যাহারের মতো সিদ্ধান্ত সরকার নেয় তার পুরো সুবিধাও তো ব্যবসায়ীরাই নিয়ে নেয়। জনগণ এটির সুফল পায় না।
কোথাও না কোথাও একটা ঘাটতি আছেই, না হলে এমন হবে কেন? এ কথা সত্য যে,ব্যবসায়ীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার সংকট আছে। বড় ধরনের প্রশ্ন থাকে তাদের অতি মুনাফার অন্তহীন লোভ নিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু বড় কোম্পানির একটা একচেটিয়াত্ব আছে। কারণ ভোগ্যপণ্যের বাজার কয়েকটি পণ্যের কাছে বন্দি হয়ে আছে। বলা হতো মূল্যবৃদ্ধির একটা বড় কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজি। সেটা এই নতুন আমলে তো থাকার কথা নয়। তবে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হচ্ছে যে,চাঁদাবাজির রাজনৈতিক হাত ও রঙ বদল হয়েছে,কিন্তু চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে।
মানুষের আয়-রোজগার বাড়ছে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। মানুষ ক্ষমতার পরিবর্তন চেয়েছিল,সেটা পেয়েছে। এখন জানতে চায় তাদের জীবন মানের পরিবর্তন আসছে না কেন? কেন তাদের জীবন এতো কষ্টের?
৮০ শতাংশ মানুষ এখন গ্রামে বাস করছে। বাকি ২০ শতাংশ শহরে বসবাস করলেও উভয় ক্ষেত্রেই একটা বড় অংশ নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। কারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা অনুন্নতির দিকে যাচ্ছে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করছে,গো পালন করছে বা ছোট ছোট ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে দুমুঠো ভাত জোগাড় করছে। শহরের অবস্থা আরও কঠিন। শহরের দরিদ্রতা নিয়ে কথা হয় কম। গ্রামের মানুষ টিকতে না পেরে শহরে চলে আসছে। একটা কথা বোধহয় আমরা বলতে ভুলে যাচ্ছি,শুধু কি দ্রব্যমূল্য? হাসপাতালে সহজে কোনো চিকিৎসা মেলে না,সহজ কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই,সন্তানের শিক্ষার সুযোগও কমে আসছে। এমনকি বাড়ছে না দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ। সেই অর্থে দক্ষতা অনুসারে মানুষের আয়ের কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো বৃদ্ধ বয়সে মানুষের জীবনটা যে নিশ্চিন্তে কাটবে সেটাই বাংলাদেশে নেই। সুতরাং কিছুই আসলে নেই বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জন্য।
মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে আসলে সরকারি গল্পের কিছুই মিলছে না। তাহলে করতে হবে কি? আসল কাজ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং মানুষের আয় বাড়ানো। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না। বরং মানুষের নিশ্চিত আয় থাকলে এ নিয়ে প্রশ্ন করবে কম।
আয় বাড়ানো এবং দ্রব্যমূল্য কমানো দুটোই অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ,তবে কোনটি বেশি প্রয়োজন,তা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। আয় বৃদ্ধি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায়,যা ব্যক্তিগত ও পরিবারের জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা করে। আয় বাড়লে মানুষ বেশি খরচ করতে পারে,যার ফলে অর্থনীতির চাহিদা বাড়ে। তবে, দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে আয়ের বাড়তি অংশ খরচের দিকে চলে যেতে পারে,যা জীবনযাত্রার মানে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে নাও পারে। অন্যদিকে,দ্রব্যমূল্য কমানো মানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। এতে মানুষের জীবনের খরচ কমে।
অতিরিক্ত খরচে নাভিশ্বাস উঠলেও মানুষ এই জুলুম মেনে নিতে বাধ্য হয়। তাদের কিছু করার থাকে না। ডিম,সবজি, চালসহ নিত্যপণ্যের দাম কমাতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। প্রশ্ন হলো,টাস্কফোর্সের পক্ষে কি এ ভাবে বাজারে হানা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানা সম্ভব? সম্ভব না। বাজারে বিক্রি হওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বর্তমান দাম আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় যতই বেশি মনে হোক,এ বিষয়ে বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করা কঠিন। দাম বেধে দিয়ে দাম কমানো যায় না যেটা সরকার করতে চাচ্ছে। অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধ করতেই হবে এবং একই সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালে বেঁধে রাখতে হলে প্রচলিত আইনগুলির উপভোক্তা-বান্ধব হয়ে ওঠার সংস্কারকাজটাও করতে হবে। আর মানুষকে আয় বাড়ানোর সুযোগ করে দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক