পাঁচ দশক পরও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিশ্বমানের সিনেমার অভাব
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠন, আধুনিক জাতিসত্তা নির্মাণ এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের পুনর্গঠনের জন্য এক গভীরতম ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই যুদ্ধের প্রকৃতি ছিল বহুমাত্রিক– উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের সংগ্রাম, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাঙালির অবস্থান পুনর্নির্ণয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্যিক জাতীয় অভিজ্ঞতা, যার প্রভাব রাজনৈতিক সীমারেখা ছাড়িয়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও সম্মিলিত স্মৃতিকে দীর্ঘমেয়াদি আকার দিয়েছে।
স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা ও রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে। এটি বিশ্বের অনেক জাতি গঠনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মিশেল ফুকোর ভাষায়, 'পাওয়ার প্রোডিউসেজ নলেজ' অর্থাৎ ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ঐতিহাসিক ঘটনাকে নির্দিষ্ট কাঠামোতে ফ্রেম করে এবং সেই ফ্রেমিং জনচেতনাকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশেও প্রতিটি শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধকে তাদের রাজনৈতিক বৈধতা এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ ব্যাখ্যার অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছে, ফলে একই ঘটনার বহুস্তরীয়, কখনও কখনও পরস্পরবিরোধী পাঠ সৃষ্টি হয়েছে।
চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নানাভাবে দৃশ্যমান করেছে। চলচ্চিত্রতত্ত্বের আলোকে বলা যায়, জাতীয় ট্রমা ও বিজয়– উভয়ই চলচ্চিত্রে রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভ এবং সৃজনশীল ন্যারেটিভের দ্বন্দ্বকে সামনে আনে। বহু দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একই ঘটনার পুনর্ব্যাখ্যা চলচ্চিত্রে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সমসাময়িক ভারতে কাশ্মীরভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব স্পষ্ট। ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তিত হলে একই বিষয় অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও উপস্থাপিত হবে– এটি বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেও এই রাষ্ট্রীয় প্রভাব বিদ্যমান, তবে তা ইতিহাসের মূল সত্যকে প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। শিল্পীসত্তা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং লোকস্মৃতি মিলেই চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের বহুস্তরীয় রূপ তুলে ধরে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ একটি 'কনটেস্টেড হিস্ট্রি' হলেও তার নৈতিক ভিত্তি অটুট থাকে।
স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বমানের সিনেমা নির্মাণ হয়নি। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিশ্বমানের বৃহৎ স্কেলের চলচ্চিত্র তৈরি না হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতা। এই ঘাটতির পেছনে বহু কারণ রয়েছে এক. অপর্যাপ্ত প্রযোজনা বাজেট দুই. বাজার সংকোচন ও দর্শক-সংস্কৃতির অভাব, তিন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সীমাবদ্ধতা। তাই নির্মাতারা সীমিত সম্পদে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিলেও অধিকাংশ চলচ্চিত্র কাঙ্ক্ষিত ভিজ্যুয়াল গভীরতা ও প্রযোজনাগত শক্তি অর্জন করতে পারেনি। একাডেমিক পর্যবেক্ষণে বলা যায়– এটি কেবল শিল্পীসংঘাত নয়; এটি একটি কাঠামোগত সংস্কৃতিগত সমস্যা।
তবুও আশাবাদের জায়গা আছে। নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা বৈশ্বিক চলচ্চিত্র ভাষা, পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ, এবং যুদ্ধ-স্মৃতির নানান তাত্ত্বিক কাঠামোতে বেশি দক্ষ। আন্তর্জাতিক সহপ্রযোজনা, ডায়াসপোরা দর্শক এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের প্রসারের ফলে বড় বাজেটের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রকল্প তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। একটি পরিপক্ব চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির লক্ষ্য হওয়া উচিত– মুক্তিযুদ্ধকে কেবল আবেগের ইতিহাস হিসেবে নয়; বরং রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব, মানবিক ট্রমা, প্রতিরোধ, অন্তর্ভুক্তি এবং নৈতিক দর্শনের এক জটিল অভিজ্ঞতা হিসেবে বিশ্বদর্শকের সামনে উপস্থাপন করা।
Comments