যেভাবে লালন সম্রাজ্ঞী হলেন ফরিদা পারভীন

লালনসম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে স্তব্ধ সংগীতাঙ্গন। ৫৫ বছরের সঙ্গীতজীবনের পর্দা নামালেন তিনি। তবে তার গাওয়া গান বাঙালির মনকে প্রশান্তি দেবে যুগের পর যুগ।
১৯৫৪ সালে নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেন ফরিদা পারভীন। পরিবারেই ছিল সংগীতের পরিবেশ- দাদি গান করতেন, বাবার ছিল সঙ্গীতে গভীর অনুরাগ। ছোটবেলা কেটেছে মাগুরায়। ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির শিশু। দাদা-নানাবাড়ির মাঝের নদী পার হয়ে খেলাধুলায় মেতে উঠতেন মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে। স্কুলজীবনের শুরু মাগুরাতেই। সঙ্গীতে হাতেখড়ি ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। বাবার চাকরির কারণে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করলেও দীর্ঘদিন ছিলেন কুষ্টিয়ায়। সেখানকার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি।
১৯৬৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রাজশাহী বেতারে নজরুলশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। প্রথমে গেয়েছেন নজরুল, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান। তার কণ্ঠে গাওয়া 'এই পদ্মা এই মেঘনা' এখনো স্মৃতিকাতর করে সংগীতপ্রেমীদের। স্বাধীনতার পর কুষ্টিয়ায় পারিবারিক বন্ধু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনগীতির তালিম নেন। পরে খোদাবক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, ইয়াছিন সাঁই, করিম সাঁইসহ আরও অনেকের কাছে লালনের গান শিখে তিনি আত্মনিয়োগ করেন লালনসঙ্গীতে।
শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। এ প্রসঙ্গে ফরিদা পারভীন বলেছিলেন, 'নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি, তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন। তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি। আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, "ভালো না লাগলে গাইবি না।" এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি। "সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন", লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, "আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।" এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।'
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান ছিল তার অনুপ্রেরণা। রেডিওতে তার কণ্ঠ শুনে ফরিদা মুগ্ধ হতেন, যদিও নাম জানতেন না তখন।
ব্যক্তিগত জীবনে ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী ছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার ও শিল্পী আবু জাফর। সেই সংসারে তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে- জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি। গান গাওয়ার জন্যই প্রথম সংসার ভেঙ্গে যায়। পরে তিনি বাঁশিশিল্পী গাজী আবদুল হাকিমকে বিয়ে করেন।
ফরিদা পারভীন শুধু দেশে নয়, বিশ্বদরবারেও ছড়িয়ে দিয়েছেন লালনের বাণী। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশে গেয়েছেন লালনের গান। ফরিদা পারভীনের গাওয়া আধুনিক, দেশাত্মবোধক কিংবা লালন সাঁইয়ের গান সমান ভাবেই জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে' 'তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম', 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বলো', 'খাঁচার ভিতর', 'বাড়ির কাছে আরশি নগর' ইত্যাদি।
সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন একুশে পদক (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩, 'নিন্দার কাঁটা' গানটির জন্য), এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ ফুকুওয়াকা পুরস্কার (২০০৮)।
তার মৃত্যুতে লালনসঙ্গীত হারাল এক সুধাময় কণ্ঠ, আর বাঙালি হারাল এক সাংস্কৃতিক সম্পদ।
Comments