নবীজির বর্ণনায় জাহান্নামের শাস্তি যেমন

আমরা কি কখনো ভেবেছি, পৃথিবীতে আমাদের কর্মগুলো আমাদের জন্য শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে, নাকি চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার? মহান আল্লাহ আমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন দুটি পথ, একটি শান্তির, আরেকটি শাস্তির। আর যারা আল্লাহ ও তার নবীর বিরোধিতা করবে, তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার স্থান—জাহান্নাম।
মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, তারা কি জানে না, যে আল্লাহ ও তার রসুলের বিরোধিতা করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা চিরস্থায়ী অবস্থান করবে। (সুরা তাওবা ৬৩)
মৃত্যুর পর আখিরাতে সব মানুষের শেষ ঠিকানা হবে জান্নাত বা জাহান্নাম। যারা সত্যিকারের ঈমান গ্রহণ করেছেন, সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করেছেন, তাদের জন্য আখিরাতে আল্লাহ তাআলা পুরস্কারস্বরূপ জান্নাতের সুখ-শান্তি ও সম্মান দান করবেন। তারা জান্নাতে চিরন্তন সুখে বসবাস করবেন।
অন্যদিকে, যারা ঈমান আনেননি, গুনাহের পথে নিজেদের জীবন কাটিয়েছেন, তাদের জন্য আল্লাহ আখিরাতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেছেন। সেখানে তাদের জন্য থাকবে ভয়াবহ যন্ত্রণা ও বেদনাদায়ক জীবন।
জান্নাত ও জাহান্নামের রহস্য আমাদের কাছে একান্ত কৌতূহলের বিষয়, তবে এ সম্পর্কে আমাদের তেমন সুস্পষ্ট ধারণা নেই। নবীজি (সা.) মিরাজের রাত্রিতে জান্নাত ও জাহান্নামের যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, কোরআন-হাদিসে এ সম্পর্কিত
যে বর্ণনা রয়েছে, আজ এসবই আমাদের আলোচ্য বিষয়।
নবীজি জাহান্নামের শাস্তি সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন
নবীজি মিরাজের সফরে উর্ধ্ব জগতে একদল লোককে দেখলেন, তাদের নখগুলো তামার। নিজেদের নখ দিয়ে তারা নিজের গাল ও বুকে আঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল! এরা কারা?
বললেন, এরা ওই সমস্ত লোক, যারা মানুষের গোশত খেত ও তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গীবত করত আর মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (মুসনাদে আহমাদ ১৩৩৪০, সুনানে আবু দাউদ ৪৮৭৮)
এ সফরে নবীজি দেখলেন, একদল লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা? জিবরাঈল বললেন, এরা বক্তৃতা করত বটে, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। (মুসনাদে আহমাদ ১২২১১, ১২৮৫৬)
হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত উল্লিখিত হাদিসে আরো এসেছে, নবীজি বলেন, এ ছাড়া জাহান্নামের মধ্যে ওই নারীকেও দেখতে পেলাম, যে একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল। এরপর এটাকে আহারও দেয়নি, ছেড়েও দেয়নি, যাতে জমিনের পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারত। শেষ পর্যন্ত বিড়ালটি ক্ষুধায় ছটফট করে মারা গেল। (মুসলিম ৯০৪)
মিরাজের সফরে নবীজির দেখা জাহান্নামের বর্ণনা দিতে গিয়ে নবীজি আরও বলেন, আমি এমন এক দল নারীর কাছে এলাম, সাপ যাদের স্তনে দংশন করছে। আমি বললাম, এদের কী হয়েছে? সে বলল, এসব নারী তাদের সন্তানদের দুধ পান করাতো না। (মুসতাদরিকে হাকিম ২৮৩৭)
তারপর চিত হয়ে শোয়া এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। এখানে দেখলাম এক ব্যক্তি লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সে তার চেহারার একদিক থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত ও নাকের ছিদ্র থেকে মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত আর চোখ থেকে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। তারপর লোকটি শোয়া ব্যক্তির অপর দিকে যাচ্ছে, প্রথম দিকের সঙ্গে যেরূপ আচরণ করেছে অনুরূপ আচরণ অন্য দিকের সঙ্গেও করছে। ওই দিক থেকে অবসর হতে না হতেই প্রথম দিকটি আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। তারপর আবার প্রথমবারের মতো আচরণ করছে। সে হলো ওই ব্যক্তি যে মিথ্যা গুজব চতুর্দিক ছড়িয়ে দিতো। (সহিহ বুখারি ৭০৪৭)
নবীজি আরো বলেন, আমরা চলতে চলতে চুলার মতো একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে শোরগোল ও নানা শব্দ ছিল। আমরা তাতে উঁকি মেরে দেখি, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী-পুরুষ আছে। আর নিচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করছে। যখনই লেলিহান শিখা তাদের স্পর্শ করছে, তখনই তারা উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠছে। তারা হলো ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণীর দল। (বুখারি ৭০৪৭)
উল্লিখিত হাদিসে আরো এসেছে, আমরা চলতে লাগলাম, একটি নদীর কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। নদীটি ছিল রক্তের মতো লাল। আর দেখলাম, সেই নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অন্য এক ব্যক্তি আছে, সে তার কাছে অনেক পাথর একত্র করে রেখেছে। আর ওই সাঁতাররত ব্যক্তি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসছে, যে তার কাছে পাথর একত্র করে রেখেছে। সেখানে এসে সে তার সামনে মুখ খুলে দিচ্ছে আর ওই ব্যক্তি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে চলে গিয়ে আবার সাঁতার কাটছে, আবার তার কাছে ফিরে আসছে। আর যখনই ফিরে আসছে তখনই ওই ব্যক্তি তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সে হলো সুদখোর। (বুখারি ৭০৪৭)
মিরাজের রাতে নবীজি জাহান্নামে যাদেরকে দেখেছেন
এছাড়াও মিরাজের রাতে মহানবী (সা.) আরও কিছু ব্যক্তিকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে দেখেন, যাদের অপরাধ ছিল বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ও পাপ। নবীজি জাহান্নামে দেখতে পান পরনিন্দাকারীকে। যাদের নখ দিয়ে মুখ ও বুক আঁচড়ানো হচ্ছিল। তারা ছিল সেইসব লোক যারা মানুষের গোশত খেত এবং সম্মানহানি করত। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৮)
বদ-আমল বক্তাদেরও দেখেন জাহান্নামে। যারা ভালো কাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করতেন না। তাদের ঠোঁট কাটা হচ্ছিল। (মুসনাদে আহমদ ১২২১১) কোরআন ত্যাগকারী মানুষকেও নবীজি জাহান্নামে শাস্তি ভোগ করতে দেখেছেন। নবীজি দেখেন কোরআন মুখস্থ করে তা বর্জনকারী ব্যক্তির মাথায় পাথর নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭০৪৭)
সুদখোর ব্যক্তিকেও নবীজি জাহান্নামে দেখেছেন। যারা সুদ খেত, তাদেরকে রক্তের মতো লাল নদীতে সাঁতার কাটানো হচ্ছিল। মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছিল। (বুখারি ৭০৪৭)
জাহান্নামের নানা স্তরের আজাবের সবচেয়ে কম শাস্তি হবে আগুনের ফিতাযুক্ত জুতা পরানো। হজরত নোমান বিন বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, জাহান্নামে যাকে সবচেয়ে কম শাস্তি দেয়া হবে তাকে জাহান্নামের দুটি জুতা পরানো হবে, যার দুই ফিতা হবে আগুনের। এর উত্তাপে মাথার মগজ টগবগ করতে থাকবে ফুটন্ত পানির মতো। সে মনে করবে তাকে সবচেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মূলত তাকে সবচেয়ে কম শাস্তি দেয়া হচ্ছে। (মুসলিম ২১৩)
আমরা জানি, পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী। আজকে জাহান্নামের শাস্তির ভীতিকর বিবরণ শুনে আমাদের হৃদয়ে হয়তো ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের এ ভীতি থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফিক দান করেন। আল্লাহর পথে পরিচালিত করেন। আমরা যেন এমন জীবন যাপন করি, যা আমাদের আখিরাতে জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় নিয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। জান্নাতের যোগ্য করে তুলুন, আমিন।
Comments