বিশ্ব কূটনৈতিক ভুবনে নতুন শক্তি সৌদি আরব

সৌদি আরব ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের পরিচয় বদলে ফেলছে। একটি কট্টর মুসলিম দেশের পরিচয় ছাপিয়ে হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী এক দেশ। রিয়াদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে দেশটি হয়ে উঠতে চায় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক কূটনৈতিক আলোচনা ও দর কষাকষির প্রাণ কেন্দ্র।
মঙ্গলবার ইউক্রেন বিষয়ে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে সৌদি আরবে। কেন মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশকে বেছে নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন সে নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। যে আলোচনাই হোক,একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে, ২০১৮ সালে তুরষ্কে সা্ংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যার পর সৌদি আরব আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বের মাধ্যমে যেভাবে একঘরে হয়ে গিয়েছিল এখন আর সে অবস্থা নেই।
আন্তর্জাতিক ফোরামে সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে মাঝে মাঝে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও দেশটিকে এবং এর প্রকৃত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে আর পশ্চিমারা এড়িয়ে চলতে পারছে না। চলচ্চিত্র, সংস্কৃতি, ক্রীড়া সহ বিভিন্ন বিষয়ে সৌদি আরব এখন গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু। তার সাথে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক আঙ্গিনায় দেশটির সক্রিয়তা।
একদিকে যখন ইউক্রেন যুদ্ধের ইতি টানতে রাশিয়া-আমেরিকার বৈঠক হচ্ছে, তখন একই সময়ে শুক্রবার হতে যাচ্ছে গাল্ফ কো-অপারেটিভ কাউন্সিলের ছয়টি দেশের বৈঠক। সাথে যুক্ত করা হয়েছে জর্দান এবং মিশরকে। তারা আলোচনা করছে ফিলিস্তিনের গাজার ২২ লক্ষ মানুষকে অন্য জায়গায় না সরিয়ে এই ভূখন্ডকে আবার কীভাবে নির্মাণ করার যায় সে বিষয়ে। চূড়ান্ত প্রস্তাবনা তুলে ধরা হবে এ মাসের শেষে কায়রোতে আরব নেতাদের এক বৈঠকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজাবাসীকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার বিপরীতে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সংঘাত নিরসনে আলোচনার স্থান হিসেবে সৌদি আরবের এই নতুন পরিচয় দেশটির পররাষ্ট্র নীতির স্বার্থকতা ও সক্রিয়তা প্রমাণ করে। বাইডেন প্রশাসনের সময় সৌদি আরব তার ঐতিহ্যগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব স্বার্থের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। রিয়াদ এখন রাশিয়া ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে। ট্রাম্প গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তার প্রতিবাদ করে সৌদি আরব নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটি বিভিন্ন বৈশ্বিক সংঘাতে নিরপেক্ষ অবস্তানে থাকছে সৌদি আরব। ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে খুবই সতর্ক পদক্ষেপ নিয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। ২০২৩ সালের মে মাসে ইউক্রেন প্রসিডেন্ট ভলোদোমির জেলেন্সকি জেদ্দায় আরব লীগের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেন। এবং আবারও জেলেন্সকি সৌদ আরবে আসছেন আমেরিকা-রাশিয়া বৈঠক শেষ হওয়ার পর। একইভাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সৌদি আরবে যান এক রাষ্ট্রীয় সফরে। আলোচনা করেন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংঘাত সফলভাবে মধ্যস্থতা করতে সক্ষম একটি বৈশ্বিক শক্তি হয়ে উঠতে চায় সৌদি আরব। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আমেরিকা-রাশিয়া বৈঠক, গাজা বিষয়ে পরিকল্পনা, পৃথকভাবে জেলেন্সকির সফর এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা দিতে সম্মত না হওয়া, চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করা – সবই সৌদি আরবের জন্য মর্যাদাপূর্ণ। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে জোর দিচ্ছে রিয়াদ। ভারতে জ্বালানি সরবরাহে সৌদি আরবের অবস্থান তৃতীয়। এসব উদোগ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গনে দেশটির পরোক্ষ প্রভাব বৃদ্ধি করছে।
পুরো আরব বিশ্ব যেখানে কিছুটা ম্রিয়মাণ,সেখানে সৌদি আরব সবার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করছে ভিন্ন এক শক্তি হিসেবে। সৌদি আরব ক্রমেই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।
Comments