সিরিয়ার বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে হাত বাড়াবে তুরস্ক
দীর্ঘ ১৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের থাবায় বর্তমানে প্রায় বিধ্বস্ত সিরিয়ার অর্থনীতি। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা; বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারও শূন্যপ্রায়। এ অবস্থায় বিদ্রোহীদের অভিযানে বিদ্যুৎগতিতে সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতন হলেও দেশটির অর্থনীতির পুনর্গঠন ততটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ।
দীর্ঘ এ যুদ্ধে মারা গেছে ৫ লাখ সিরীয় নাগরিক; উদ্বাস্তু হয়েছেন আরও কোটি খানেক সিরীয়। দেশের ভেতরে যারা বেঁচে আছেন তাদের ৯০ শতাংশই বর্তমানে অবস্থান করছেন দারিদ্র্যসীমার নিচে।
তবে অর্থনীতির এ বেহাল দশার মধ্যে সিরীয়দের নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তুরস্ক। ধারণা করা হচ্ছে, যেভাবে গৃহযুদ্ধের বছরগুলোতে সাধারণ সিরীয়দের পাশে ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসিপ তাইয়েপ এরদোয়ান, তেমনি ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনৈতিক পুনর্গঠনেও পাশে এসে দাঁড়াবেন তিনি।
বিশ্বের তিনটি মহাদেশ - ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার সবচেয়ে নিকটবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিরিয়াকে। এছাড়া, ঐতিহাসিকভাবেই দেশটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। বিশ্বে এর অবস্থান গুরত্বপূর্ণ বিধায় সভ্যতার ইতিহাসের শুরু থেকেই বিশ্বের শক্তিমান সাম্রাজ্যগুলো নিজেদের হাতে রাখতে চেয়েছে দেশটির নিয়ন্ত্রণ। সিরিয়ার আকর্ষণীয় এ ভৌগোলিক অবস্থানকেই এ মুহূর্তে দেশটির অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে খুব দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে সিরিয়াকে। পাশাপাশি অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাত পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের। আর ঠিক এ জায়গাতেই সিরিয়ার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে তুরস্ক।
কারণ বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত তুরস্কের রয়েছে বিনিয়োগ করার মত যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য। এর পাশাপাশি প্রযুক্তি ও অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে আঙ্কারার সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলোর। এছাড়া, তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার বিশাল সীমান্ত এবং যুদ্ধের সময় তুরস্কে ৪০ লাখ সিরীয় নাগরিকের আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে।
যুদ্ধের মাঝেও সিরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন অব্যাহত ছিলো তুরস্কের। বিশেষ করে সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রায় পুরোটাই ছিলো তুরস্কনির্ভর। আনাদোলু নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর তুরস্ক সিরিয়া থেকে আমদানি করে ৩৬ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে রফতানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
দুদেশের বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে আনাদোলু জানায়, সিরিয়ার কৃষি, নির্মাণ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে তুরস্কের কোম্পানিগুলোর সামনে। এরই মধ্যে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ১১টি 'সেফজোন' প্রতিষ্ঠা করেছে তুরস্ক। পাশাপাশি ইদলিবসহ আরও অন্যান্য অঞ্চলেও 'সেফজোন' প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে আঙ্কারা। এসব 'সেফজোন' শিল্প ও বিনিয়োগের জন্য আদর্শ স্থানে পরিণত হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়ার ১৪টি প্রধান শহরে ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের কারণে সংঘটিত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ১১ বিলিয়ন ডলার।
যুদ্ধ পরবর্তী সিরিয়ার অর্থনীতির সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে গবেষক আলি মামুরি বলেন, সিরিয়ার নতুন সরকারকে খুব শিগগিরই অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধারের জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করতে হবে এবং এর পাশাপাশি দেশের মুদ্রাব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে হবে।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সবার আগে জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামো খাতকে পুনর্গঠন করতে আকর্ষণীয় করতে হবে বিদেশি বিনিয়োগ। বিশেষ যুদ্ধের কারণে অবকাঠামো প্রায় পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ায় তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য রাস্তাঘাটসহ নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি এবং যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তোলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত হলেও এখনও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে সিরিয়ার তেল ও গ্যাস শিল্প এবং কৃষিখাত। যদিও যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার তেল ও গ্যাস উৎপাদন বর্তমানে প্রায় তলানিতে। তারপরও সেখানে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ আছে।
অন্যদিকে, ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকায় অবস্থিত সিরিয়ার উর্বর অঞ্চলগুলোও কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। পাশাপাশি সিরিয়ার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যও দেশটিকে পরিণত করতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যটনের একটি আকর্ষণীয় স্থানে।
আলি মামুরি বলেন, সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিকে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে তুলে ধরতে পারে। বিশেষ করে ইরাক, জর্ডান, তুরস্ক ও ইউরোপের মধ্যে সেতুবন্ধন হতে পারে সিরিয়া।
সিরিয়ার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তুরস্কের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অবকাঠামো, জ্বালানি, পরিবহন ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে বিনিয়োগ করতে পারে তুরস্কের কোম্পানিগুলো। পাশাপাশি তুরস্কের ভেতর দিয়ে কাতারের তেল গ্যাস ইউরোপে সরাসরি পাইপলাইনে রফতানির ক্ষেত্রেও ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে সিরিয়া।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের কো-ডিরেক্টর জশুয়া ল্যান্ডিস নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, গৃহযুদ্ধ শুরুর আগেও সিরিয়ার রাজস্বের অর্ধেকই আসতো দেশটির জ্বালানি শিল্প থেকে। সে সময় এ তেল ক্ষেত্রগুলো আগে দামেস্কের সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিলো।
এ খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে জ্বালানি ক্ষেত্রগুলোকে পুনরায় দামেস্কের নিয়ন্ত্রণে আসতে হবে। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার তেল গ্যাস খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়। কারণ যুদ্ধের কারণে অধিকাংশ তেলক্ষেত্রই বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত।
ইরাক, জর্ডান ও মিশরের সঙ্গে থাকা পাইপলাইনগুলোও বিধ্বস্ত। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধের আগে যেখানে সিরিয়ার দৈনিক তেল উৎপাদন ছিলো প্রায় পৌনে চার লাখ ব্যারেল, সেখানে বর্তমানে তেল উৎপাদন নেমে এসেছে দৈনিক ৯০ হাজার ব্যারেলের নিচে। বর্তমানে চাহিদার থেকে কম উৎপাদন করায় সিরিয়া পরিণত হয়েছে জ্বালানি আমদানিকারক দেশে।
তবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ পেলে ফের ফিরতে পারে সিরিয়ার জ্বালানি খাতের হাল। সেক্ষেত্র সিরিয়ার জ্বালানি রফতানির আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে তুরস্ক। কারণ তুরস্কের প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বেশিরভাগই জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও নিজেদের তেল গ্যাসের প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয় তুরস্ককে। এ পরিস্থিতিতে সিরিয়ার জ্বালানি খাত হতে পারে তুরস্কের জন্য বিনিয়োগের আকর্ষণীয় ক্ষেত্র।
এছাড়া, সিরিয়ার নির্মাণ, সিমেন্ট ও স্টিল খাতে তুরস্কের কোম্পানিগুলোর অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে বলে রয়টার্সকে জানান, তুরস্কের কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান ইনফো ইয়াতিরিম এর হেড অব গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ ইউসুফ দোগান। তিনি বলেন, সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে দেশটির অবকাঠামো খাত পুননির্মাণে এগিয়ে থাকবে তুরস্কের কোম্পানিগুলো।
তুরস্কের সিমেন্ট উৎপাদন কোম্পানিগুলোর সংগঠন তুর্কসিমেন্টোর প্রধান নির্বাহী ভলকান বোজে সিরিয়ার সিমেন্ট খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরে রয়টার্সকে বলেন, দেশটির নির্মাণ খাত বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্নিমাণের ক্ষেত্রে।
তার মতে, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে সিমেন্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং যখন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন এর চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি সিরিয়ার প্রতিবেশী হওয়ায় তুরস্কের কোম্পানিগুলো এ খাতে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে বলেও রয়টার্সকে জানান তিনি।
এদিকে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া পুনর্গঠনে এরই মধ্যেই নিজের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) মিশর সফর থেকে দেশে ফেরার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শিক্ষা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা -- সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রেই সিরিয়াকে সহযোগিতা করবে তুরস্ক।
পাশাপাশি সিরিয়া বর্তমানে ব্যাপক জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা করছে উল্লেখ করে এরদোয়ান বলেন, খুব দ্রুতই সিরিয়ার জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় পদক্ষেপ নেবে আঙ্কারা।