গ্যাসের দাম বাড়ালে নতুন কোন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে না

সরকার শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য গ্যাসের দাম দ্বিগুনের বেশি বাড়াতে চায়। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশে নতুন কোনো শিল্প গড়ে উঠবে না। সম্প্রসারণ হবে না বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্যের। সার্বিকভাবে দেশে শিল্প-কারখানা থাকবে না। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ও ইকোনমিক রিপোর্টারস ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক সেমিনারে গতকাল এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন ব্যবসায়ী নেতারা। 'জ্বালানি সহজলভ্যতায় নীতি ও শিল্প প্রতিযোগিতায় প্রভাব' শীর্ষক সেমিনারটি রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত হয়।
জ্বালানি বিভাগের অনুমোদন নিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এ ক্ষেত্রে শিল্পে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পুরো গ্যাস বিল হবে নতুন দামে। তবে পুরনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ প্রস্তাব আমলে নিয়ে আগামী বুধবার শুনানি ডেকেছে বিইআরসি।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, 'বর্তমান সরকার গ্যাস সংকট কাটিয়ে উঠতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে।' তবে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বুধবার শুনানি থাকায় এ বিষয়ে তার বেশি কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে তারা (বিইআরসি) যেন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সে জন্য সব পক্ষের কথা শুনছেন।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, 'সরকার নতুন শিল্পের জন্য ১৫০ শতাংশ এবং সম্প্রসারণ শিল্পের জন্য ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। এমন পরিকল্পনার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ; আমরা আর কেউ শিল্প করতে চাই না। তবে বর্তমান শিল্পকে সহায়তা করবেন না, এটা হতে পারে না।'
সস্তা গ্যাসের কারণে দেশে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না। ব্যাংকে সুদের হার বেশি; এনবিআরেও অন্য সমস্যা আছে। এ অবস্থায় অযৌক্তিকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ালে উদ্যোক্তারা কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না। বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণও হবে না। '
সেমিনারে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, 'গ্যাসের বর্তমান দাম কমানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করা দরকার। কমিশন খাওয়ার জন্য স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে অস্থির ছিল বিগত সরকারের লোকজন। তারা বিদেশে বসে এখনো কমিশন খাচ্ছে। উদ্যোক্তারা মূলত ফেঁসে গেছেন। গ্যাসের দাম বাড়ানো তো দূরে থাক, কমানো না গেলে শিল্প থাকবে না।'
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১১ টাকা ৫৮ পয়সার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ওই সময় শিল্পে ১৫০-১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানো হয়। এরপর গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা আরো খারাপ হয়, পরে প্রকট আকার ধারণ করে।
তিনি বলেন, '২০২২ সালের আগে যে শিল্প ইউনিটে গ্যাস বিল ২ কোটি ১০ টাকা ছিল, মূল্যবৃদ্ধির পর সেটি ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা হয়। প্রস্তাবিত মূল্য কার্যকর হলে সেটি বেড়ে হবে ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা হবে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে কারখানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।'
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, '২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি দেশে নেই।'
ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, 'বিদেশী বিনিয়োগ কম এটি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশী উদ্যোক্তারা মরিয়া হয়ে নাই। বাংলাদেশ অনেকগুলো বিনিয়োগ গন্তব্যের একটি মাত্র, এটি খেয়াল রাখতে হবে। দেশে জ্বালানির টেকসই ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। একই সঙ্গে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি দেশী-বিদেশী উভয় বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, 'বাংলাদেশ কখনই জ্বালানি সংকটের বাইরে ছিল না। তবে বর্তমানে এটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। গত ২০১৫-১৬ সালের দিকে দেশে ২ হাজার ৮০০ এমএফসিএফ গ্যাস উৎপাদন হলেও বর্তমানে তা ১ হাজার ৯০০ এমএফসিএফে নেমে এসেছে। এতে যারা বেশি সমস্যায় পড়বে তাদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে বড় পরিসরে পরিকল্পনা দরকার।'
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, 'এখনকার চ্যালেঞ্জিং সময়ে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করলে পণ্য উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে। এতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে, নতুন বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক খাতে নতুন করে আমদানিনির্ভরতা বাড়বে। ফলে আর্থিক খাতে চাপ পড়বে। কারণ আমদানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি লাগবে। আবার গ্যাসের দাম বাড়ালে অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে, তখন মন্দ ঋণ বাড়বে।'
সেমিনারে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার মালা। এছাড়া আরো বক্তব্য দেন বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীর আলী হোসাইন, ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন প্রমুখ।
Comments