সংস্কৃতির সংগ্রাম ।। প্রবীর সরদার

আগস্ট ১৮, ২০১৫

proঅপসংস্কৃতি মানুষের মনের ভালোমন্দ বোধ ও সুকুমার বৃত্তিগুলোকে ধ্বংস করে তাকে ঠেলে দেয় অবক্ষয়ের দিকে। সংস্কৃতিবানরা সমাজকে ধরে রাখতে চায় তার সংস্কৃতি বিকাশের মধ্য দিয়ে। তাই তারা সমাজের অপশক্তিঘুলোর টার্গেটে পরিণত হয়। উদীচী ও ছায়ানটে বোমা হামলা তারই পরিচায়ক। একজন সুস্থ সংস্কৃতিবান মানুষই অপশক্তির প্রথম টার্গেট, ইতিমধ্যে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে।

 

সংস্কৃতির সংগ্রাম ।। প্রবীর সরদার

‘আমরা চাই কলমকে
বন্দুকের সমকক্ষ করতে
শিল্পায়ন তালিকায় এর স্থান হোক
লোহালক্করের পাশে’- কবি মায়াকভস্কি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বলেছেন, সংস্কৃত ভাষায় কর্ষণ বলতে বিশেষভাবে চাষ করাই বোঝায়, ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গযোগে মূল ধাতুটাকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থবাচক করা যেতে পারে, সংস্কৃত ভাষার নিয়মই তাই। উপসর্গভেদে এক কৃ ধাতুর নানা অর্থ হয়, যেমন- উপকার বিকার আকার। কিন্তু উপসর্গ না দিয়ে কৃতি শব্দকে আকৃতি প্রকৃতি বা বিকৃতি অর্থে প্রয়োগ করা যায় না। উৎ বা প্র উপসর্গযোগে কৃষ্টি শব্দকে মাটির থেকে মনের দিকে তুলে নেওয়া যায়, যেমন উৎকৃষ্টি, প্রকৃষ্টি। ইংরেজি ভাষার কাছে আমরা এমনি কী দাসখৎ লিখে দিয়েছি যে তার অবিকল অনুবর্তন করে ভৌতিক ও মানসিক দুই অসবর্ণ অর্থকে একই শব্দের পরিণয়-গ্রন্থিতে আবদ্ধ করব?

বৈদিক সাহিত্যে সংস্কৃতি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তাতে শিল্প সম্বন্ধেও সংস্কৃতি শব্দের প্রয়োগ আছে। “আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি।” “ছন্দোময়ং বা এতৈর্যজমান আত্মানং সংস্কুরুতে”Ñ এই-সকল শিল্পের দ্বারা যজমান আত্মার সংস্কৃতি সাধন করেন। সংস্কৃত ভাষা বলতে বোঝায় যে ভাষা বিশেষভাবে cultured, যে ভাষা cultured সম্প্রদায়ের। মারাঠি হিন্দী প্রভৃতি অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষায় সংস্কৃতি শব্দটাই কাল্চার অর্থে স্বীকৃত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ইতিহাস (cultural history) ক্রৈষ্টিক ইতিহাসের চেয়ে শোনায় ভালো। সংস্কৃত চিত্ত, সংস্কৃত বুদ্ধি cultured mind, cultured intelligence অর্থে কৃষ্টচিত্ত, কৃষ্টবুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট প্রয়োগ সন্দেহ নেই। যে মানুষ পঁষঃঁৎবফ তাকে কৃষ্টিমান বলার চেয়ে সংস্কৃতিবান বললে তার প্রতি সম্মান করা হবে। মার্ক্সসবাদী তাত্ত্বিক ক্রিস্টোফার কডওয়েল, টেরি ঈগলটন, আন্তনিও গ্রামসি সবাই মনে করেন সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির এমন একটি স্তরে পৌছানো সম্ভব যেখানে সংস্কৃতি হবে সমাজ বিপ্লবের সবচে সহায়ক শক্তি। একই সঙ্গে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর শিল্প-সাহিত্যে যে বিপ্লব সূচিত হয়েছে তা সারা বিশ্বের ক্ল্যাসিক সাহিত্যকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তদুপরি, সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র রাশিয়ায় কেন সারা বিশ্বের মুক্তিকামী দেশগুলোর যে পরিবর্তন তা লক্ষ্যণীয়। একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম ছাড়া সংস্কারের অন্য কোনো মাধ্যম নেই। সংস্কার থেকেই সংস্কৃতি শব্দের উৎপত্তি হেতু সংস্কৃতি চর্চার কোনো বিকল্প নেই। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সংস্কৃতি একটি জাতির মূল শক্তি। সংস্কৃতি শুন্য জাতি ইতিহাস শুন্য। তাই শ্রেণি সংগ্রামকে গতিশীল করতে হলে শ্রেণিকে শক্তিশালী ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করা জরুরি। সংস্কৃতি হচ্ছে কোনো জাতির ঐতিহ্য ও আদর্শগত মূল্যবোধ যা উৎকর্ষিত হয়েছে শত শত বছরের ভাষা, সাহিত্য ও সুরুচির ব্যপ্তি ও বিকাশের মাধ্যমে’।

আমরা যখন কোনো জাতিকে বিকশিত ও উন্নত দেখি তখন সেই জাতির সংস্কৃতির ঠিক উল্টো দিকই হচ্ছে অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি হচ্ছে মানবতা ও সৌন্দর্য বিবর্জিত একটি সংকীর্ণ পথ- যা কোনো দেশ বা জাতিকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অপসংস্কৃতি থেকে জন্ম নেয় কর্মবিমুখতা, উচ্ছৃঙ্খলতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে, যেগুলো পুঁজির অনন্য সৃষ্টি। বিকাশমান পুঁজির যদিও একটা কল্যাণকর দিকও থাকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট যার প্রধান শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশের পুঁজি পুরোটাই ডাকাতির ফসল। কোটি টাকার মালিক হয় লক্ষ মানুষকে পথে বসিয়ে। এই পুঁজির কোনো মানবিক গুণাবলী নেই। মানুষ ক্রমশ হয়ে পড়ছে স্বার্থপর ও যান্ত্রিক। মাদক বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে এরা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে তারুণ্যকে। সংস্কৃতি বিকাশের পথকে টেনে ধরছে পেছন থেকে। আর নিজস্ব সংস্কৃতি ছেড়ে গতিশীল করছে ব্যা- সঙ্গীতকে। ব্যান্ডের যেসব বাদ্যযন্ত্র তা নির্দিষ্ট একটা রিদম তুলে বাজে। শিল্পীকে ওই তালের সঙ্গে মিলতে হয়। এই সুর তাল লয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় এক ধরনের জীবনবিনাশী শখ। নেশা তাকে গিলে বসে আর সুরকে করে বিকৃত। এসব বাদ্যযন্ত্রকে যদি বাঙালি সঙ্গীতের মতো বাজানো যেত তাহলে সঙ্গীতে অভিনব সংযোজন হতে পারতো। যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে গীটার অপরিহার্য হয়ে গেছে। এক সময় আফগানিস্তান থেকে পারস্য অঞ্চলে সন্তুর একটা জনপ্রিয় লোক বাদ্যযন্ত্র ছিলো। সেটা রামকুমার শর্ম্মার মতো যন্ত্রীর হাতে পড়ে আজ বিখ্যাত একটি ক্ল্যাসিক্যাল বাদ্যযন্ত্র। এভাবে পরিবর্তনের ধারাবাহিক ঘটনা ঘটে। শিল্প সাহিত্য তথা সাংস্কৃতিক সাধনার একটা বড় কথা হলো- মাত্রাজ্ঞান ও পরিমিতি বোধ সংযোগ করা। আর এই মাত্রাজ্ঞান ও পরিমিতিবোধের অভাব ও সংযোগ সঙ্কটে সৃষ্টি হয় অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি কোনো দেশ বা জাতির জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়। এটা তথাকথিত আধুনিক সা¤্রাজ্যবাদী মুক্ত-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অন্ধকার দিক। তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করে মানুষ ভালো জিনিসই গ্রহণ করবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অবাধ-অনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকা-গুলোকে গ্রহণ করে একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ হয়ে পড়ে পীড়িত। ভালো কিছু আদান প্রদানে মানুষের মন হয় উদার-বিস্তৃত। কিন্তু মানুষ এতটাই অপরিণামদর্শী যে, তারা সংস্কৃতির ঠিক উল্টো দিকটাই গ্রহণ করে এবং নিজেকে নিক্ষেপ করে গভীর অরণ্যে যেখানে গণমানুষের ঐতিহ্যগত ও উন্নত যাপিত জীবনের সংস্কৃতির এক কানাকড়িও মূল্য নেই।

অপসংস্কৃতি মানুষের মনের ভালোমন্দ বোধ ও সুকুমার বৃত্তিগুলোকে ধ্বংস করে তাকে ঠেলে দেয় অবক্ষয়ের দিকে। সংস্কৃতিবানরা সমাজকে ধরে রাখতে চায় তার সংস্কৃতি বিকাশের মধ্য দিয়ে। তাই তারা সমাজের অপশক্তিঘুলোর টার্গেটে পরিণত হয়। উদীচী ও ছায়ানটে বোমা হামলা তারই পরিচায়ক। একজন সুস্থ সংস্কৃতিবান মানুষই অপশক্তির প্রথম টার্গেট, ইতিমধ্যে তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে।

মোটকথা, মনুষ্যত্ব ও মানব সাধনাই-সংস্কৃতি। একমাত্র এই সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সুস্থ। অপসংস্কৃতি সবসময় মানুষকে নৈতিক অবক্ষয়ের পথে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে মধ্য যুগের পথে। একজন সংস্কৃতবান এই পরিস্থিতিকে রুখে দাঁড়াবে এটাই বাস্তবতা। অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ লড়াই চলছে, চলবে ।

ঢাকা জার্নাল, আগস্ট ১৮, ২০১১১৫।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.