অক্টোবর মাসে দেশে ৪৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৪৪১ জন
দেশে গত অক্টোবর মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৮৬টি। নিহত ৪৪১ জন এবং আহত ১১২৮ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৫৭, শিশু ৬৩ । ১৯২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ১৩৭ জন, যা মোট নিহতের ৩১.০৬ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৯.৫০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ৯৮ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ২২.২২ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬২ জন, অর্থাৎ ১৪.০৫ শতাংশ।
এই সময়ে ৯টি নৌ-দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং ৪ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৪৬টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১৩৭ জন (৩১.০৬%), বাসের যাত্রী ৩০ জন (৬.৮০%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রলি আরোহী ২৪ জন (৫.৪৪%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস আরোহী ৭ জন (১.৫৮%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-স্কুলভ্যান) ১০৩ জন (২৩.৩৫%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্র) ৩৪ জন (৭.৭০%) এবং রিকশা-বাইসাইকেল আরোহী ৮ জন (১.৮১%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৬৬টি (৩৪.১৫%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৪৮টি (৩০.৪৫%) আঞ্চলিক সড়কে, ৮১টি (১৬.৬৬%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৮৭টি (১৭.৯০%) শহরের সড়কে এবং ৪টি (০.৮২%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাসমূহের ৯৯টি (২০.৩৭%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২১৭টি (৪৪.৬৫%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৩টি (২১.১৯%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৬০টি (১২.৩৪%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৭টি (১.৪৪%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রলি-ড্রাম ট্রাক তেলবাহী লরি-ট্যাঙ্ক লরি-ময়লাবাহী ট্রাক- র্যাবের গাড়ি-পুলিশের গাড়ি ২৫.৯১%, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৪০%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার ৩.৯১%, মোটরসাইকেল ২৬.১৬%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-টেম্পু-স্কুলভ্যান) ১৭.৯৫%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্র) ৭.৮৩%, বাইসাইকেল-রিকশা ২.০২% এবং অজ্ঞাত যানবাহন ২.৭৮%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৭৯১টি। (বাস ১০৬, ট্রাক ১২৩, কাভার্ডভ্যান ২১, পিকআপ ২৮, ট্রলি ৭, ড্রাম ট্রাক ১৫, তেলবাহী লরি ১, ট্যাঙ্ক লরি ২, ময়লাবাহী ট্রাক ২, র্যাবের গাড়ি ২, পুলিশের গাড়ি ৪, মাইক্রোবাস ১২, প্রাইভেটকা ১৯, মোটরসাইকেল ২০৭, থ্রি-হুইলার ১৪২ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-স্কুলভ্যান), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৬২ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-টমটম-মাহিন্দ্র), বাইসাইকেল-রিকশা ১৬ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ২২টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৬.১৭%, সকালে ২৬.৩৩%, দুপুরে ১৫.৬৩%, বিকালে ১৭.৬৯%, সন্ধ্যায় ১০.৬৯% এবং রাতে ২৩.৪৫%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৪.৮৯%, প্রাণহানি ২৫.৩৯%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.৫২%, প্রাণহানি ১২.৪৭%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ২১.৩৯%, প্রাণহানি ২০.৮৬%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.১৬%, প্রাণহানি ১২.৯২%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৩৭%, প্রাণহানি ৫.৬৬%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৩৪%, প্রাণহানি ৫.৪৪%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.৩১%, প্রাণহানি ১১.১১% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৯৬%, প্রাণহানি ৬.১২% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১২১টি দুর্ঘটনায় ১১২ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২৬টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন।
নিহতদের পেশাগত পরিচয়:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পুলিশ সদস্য ৪ জন, র্যাব সদস্য ১ জন, বিজিবি সদস্য ১ জন, শিক্ষক ১৪ জন, সাংবাদিক ২ জন, আইনজীবী ২ জন, প্রকৌশলী ৩ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৬ জন, এনজিও কর্মী ৪ জন, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ১১ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ১৮ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ১৩ জন, পোশাক শ্রমিক ৪ জন, নির্মাণ শ্রমিক ২ জন, প্রতিবন্ধী ২ জন এবং ৫১ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. ত্রুটিপূর্ণ সড়ক; ৩. বেপরোয়া গতি; ৪. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৫. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৬. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৭. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৮. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৯. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ১০. বিআরটিএ-র সক্ষমতার ঘাটতি; এবং ১১. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ'র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য:
গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে নিহত হয় ১৩.৯ জন। অক্টোবর মাসে নিহত হয়েছে ১৪.৭ জন। এই হিসেবে অক্টোবর মাসে প্রাণহানি বেড়েছে ৫.৭৫ শতাংশ।
অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারী এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকায় যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। তাই, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা এবং সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী (Regulatory) প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
Comments