বাঁচতে হলে জানতে হবে- অনুভূতির ইঞ্জিনিয়ারিং, পর্ব-৩
৮। নিজেকে আক্রান্ত বা পরিস্থিতির শিকার বলে দাবি করা (Playing the Victim)
এটাকে আমরা বলি ভিকটিম প্লেয়িং (আক্রান্ত হবার অভিনয়)। সম্ভবত যত রকমের ম্যানিপুলেশন কৌশল আছে, তার মধ্যে এটা হচ্ছে সবচেয়ে কমন। সাধারণ হলেও কাজটা সহজ নয়, যারা এই খেলা খেলেন, তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। যারা নিজেদেরকে ভিকটিম দাবি করেন, তারা দেখাতে চান- যে জগতের সকল কিছুর জন্য তাদেরকেই দুর্দশায় পড়তে হয়। তারা হচ্ছে আসল ভুক্তভোগী। যে বিষয়ই হোক, দোষ যারই হোক, একটা বিষয় তারা প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ে, সেটা হচ্ছে তারাই কেবল আসল ভুক্তভোগী। মনে করেন, আপনি তার কোনো একটা ভুল ধরিয়ে দিতে চাইলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকে সংশোধন করতে উপদেশ দিলেন। সে বলে বসলো, "তুমি সব সময় আমাকে কেন আঘাত করে কথা বল। আমি সব সময় খেয়াল করেছি যে কোনো বিষয়ে তুমি আমাকে আঘাত করতে আনন্দ পাও। একবারও তো এটা বললে না যে আমি কেন এটা করেছি, তার আগেই তুমি দোষ দিয়ে দিলে। আমার কোনো কাজে আসলে তোমার পছন্দ হয় না, তাই না?"
এই কথার পর হঠাৎ করে কিন্তু পরিস্থিতি ঘুরে গেল। আপনি তাকে সান্ত্বনা দিতে এবং তার কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যে বিষয় নিয়ে কথা শুরু করেছিলেন সংশোধন করার জন্য- সেটা চাপা পড়ে গেল। ভিকটিমের অভিনয় করা মানুষরা যেকোনো ভাবেই নিজেদেরকে ভিকটিম প্রমাণ করার জন্য খুব সহজে কান্নাকাটি করতে পারে। এরা এর মাধ্যমে মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে পারে দ্রুত। নিজেদের দোষ নিয়ে আলোচনা করার থেকে মানুষকে বিরত রাখে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ সহানুভূতিশীল এবং কেউ কান্নাকাটি করলে তার প্রতি একটু সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়। ম্যানিপুলেটররা (চালকরা) এই ব্যাপারটাই ব্যবহার করে। এদেরকে কীভাবে সামলানো যায়? তাদের আচরণের সাধারণত একটা প্যাটার্ন (ধরন) থাকে, সেই প্যাটার্নটার দিকে লক্ষ্য রাখুন। যারা সত্যিকারের ভুক্তভোগী বা ভিকটিম, তারা কিন্তু নিজেদের কোনো দোষ থাকলে সেটাকে আলাদাভাবে বলে এবং স্বীকার করে। ঠিক এই জায়গাতেই ম্যানিপুলেটররা ভিন্ন আচরণ করে। কখনোই তারা নিজেদের দোষটা স্বীকার করে না।
যখনই আপনি এই ধরনের অভিনেতাকে শনাক্ত (আইডেন্টিফাই) করতে পারবেন, তখনই একটি কথা বলবেন - অনুভূতি সত্যি হতে পারে, কিন্তু তার জন্য কৃত কাজ মিথ্যা হয়ে যায় না। প্রত্যেকের কাজের দায়িত্ব তাদেরকে নিতে হয়, এমনকি সে ভিকটিম হলেও। অনুশোচনা এবং নিজের দুর্দশার জন্য কান্নাকাটি করা এই দুইটি কাজ এক নয়। এটাই প্রতিষ্ঠিত করুন এবং তাকে জানিয়ে দিন।
৯। সামান্য যোগাযোগ রাখা (Bread crumbing)
এই কৌশলকে ইংরেজিতে বলা হয় ব্রেডক্রাম্বিং (রুটি দিয়ে প্রলুব্ধ করা)। আমাদের বাসার পোষা কুকুর বা বিড়ালকে আমরা যেমন একটু একটু করে খাবার (রুটির) দিয়ে একটা নির্দিষ্ট পথে নিয়ে আসতে পারি লোভ দেখিয়ে, এটা অনেকটা সেরকম। মনে করুন, আপনার সঙ্গী আর আপনার সাথে যোগাযোগ রাখে ততটাই, যতটুকু না হলে নয়। অর্থাৎ মনোযোগটা আকর্ষণ করার জন্য যতটুকু দরকার, কিন্তু তত বেশি সময় সে ব্যয় করে না বা তত বেশি চেষ্টা সে করে না, যতটা একজন সুস্থ স্বাভাবিক সঙ্গীর থাকার কথা। খুব সামান্য কিছু প্রশংসা বাক্য বা প্রতিশ্রুতি (প্রমিস) দিয়েই সেটার কাজ সারার চেষ্টা করে। এটাই হচ্ছে অল্প যোগাযোগ, খুব সামান্য পরিমাণে আদর-সোহাগ-ভালোবাসা দিয়ে কাউকে ধরে রাখার চেষ্টা করা, কিন্তু বড় কোনো দায়িত্ব বা অঙ্গীকার এড়িয়ে যাওয়া। এটা কেন কাজ করে? কারণ মানুষ প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে একটুখানি পেলেই আরও ভালবাসার প্রত্যাশা করে। ভিকটিম তার অভিমান ভুলে যায় সামান্য প্রাপ্তিতেই। বুঝে ওঠার আগেই সে পরবর্তী বার্তা (মেসেজ) বা পরবর্তী প্রশংসা বাক্য শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বেশ খানিকটা অপেক্ষার পরে, আবারও অল্প একটু পেলেই সে আবার নিজেকে ধন্য মনে করে। এই ইমোশনাল ম্যানিপুলেশন আপনাকে ব্যস্ত রাখতে পারে, কিন্তু যিনি আপনার সাথে এটা করছেন, তার খুব একটা সময় এবং শ্রম এর পেছনে ব্যয় হয় না।
অল্প যোগাযোগ ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতেই বেশ খানিকটা সময় চলে যায়। কীভাবে এর মোকাবিলা করতে হবে? ধরন (প্যাটার্ন) লক্ষ্য করুন। ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন পর পর ঘটনা প্রবাহকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন। যদি দেখতে পান, অল্প যোগাযোগ একটা প্যাটার্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাহলে সেটা নিয়ে কথা বলুন। বিশেষ কিছু মুহূর্ত সব সম্পর্কে থাকে, কিন্তু সেগুলোকে সব সময় ফোকাস করে প্যাটার্নকে মিস করে যাবেন না। সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্কে একজন আরেকজনের প্রতি ধারাবাহিকভাবে যত্নশীল থাকে। তাদের অন্যান্য প্রাত্যহিক জীবনের সাথেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকার কথা। অল্প কিছু পাউরুটির দানার মতো অল্প মনোযোগ দেওয়ার কথা নয় তাদের। নিজের সময় এবং শ্রমকে রক্ষা করুন। অপরের অল্প যোগাযোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। ধারাবাহিকতা এবং সত্যিকারের চেষ্টা গুলোকে আলাদা করে চিনতে শিখুন।
১০। অনুকরণ করে তুষ্ট করা (Mirroring for Manipulation)
কেউ যখন আমাদেরকে অনুকরণ করে তখন নিজের অজান্তেই আমরা খুশি হই। Imitation is the sincerest way of flattery. এখানে কে কোন উদ্দেশ্যে আপনাকে নকল করছে সেটা বোঝাটা জরুরি। মনে করুন, আপনি হঠাৎ করে এমন একজন বন্ধু পেলেন, যিনি আপনার সবকিছুই তার সাথে মিলে যাচ্ছে বলে দাবি করছেন। আপনি রবীন্দ্র সংগীত পছন্দ করেন, সে দেখা গেল একজন রবীন্দ্রবোদ্ধা, শৈশব থেকেই রবীন্দ্র প্রেমিক। একটা দু'টা বৈশিষ্ট্য (অ্যাট্রিবিউট) মিলে যেতেই পারে। দেখা গেল আপনিও ক্রিকেট খেলা পছন্দ করেন না, সেও পছন্দ করে না। আপনি ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, সেও সময় পেলেই আপনাকে ঘুরে বেড়াতে প্রস্তাব দেয়। আপনি প্রত্যেক সপ্তাহে ছুটির দিনে সিনেমা দেখেন, সেও সেটা দেখতে চায় আপনার সাথে। এক সময় মনে হবে, সে হচ্ছে আপনার জন্য একদম পারফেক্ট ম্যাচ (নিখুঁত সঙ্গী)।
সত্যি সত্যি যদি কারো সাথে আপনার অতটা মিলে যায় যে জীবন দর্শন এবং বিভিন্ন কার্যকলাপে কোনো রকমের ব্যত্য় ঘটছে না- তাহলে তো খুবই ভালো! সমস্যা হচ্ছে, এগুলো সত্যিকারের মিল নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে, এই সবগুলোই অনুকরণ করে অভিনয় করা।
সম্পর্কের প্রথম দিকে ম্যানিপুলেটররা এই কৌশল (টেকনিক) খুবই সততার সাথে পালন করে। আপনার শখের কাজ, আপনার বিভিন্ন বিষয়ের মতামত এবং জীবন দর্শন সবকিছুই তারা অনুকরণ করে নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করে। একটা সময় আপনি এত মিল দেখে বিশ্বাস করা শুরু করলেন যে, এতদিনে একটা মনের মতো নিখুঁত মিল পাওয়া গেছে। এখানেই খেলা শুরু। আপনি আপনার বাউন্ডারি (সীমা) এবং গার্ড রেইল (সুরক্ষার দেয়াল) দুর্বল করে দিলেন। তাকে বিশ্বাস করা শুরু করলেন। এবং তার কাছে নিজের গভীরতম অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনা শেয়ার করা শুরু করলেন। নিজের কিছু দুর্বলতা তার কাছে প্রকাশ করে দিলেন। সে কিন্তু এই অপেক্ষাতেই ছিল! যখনই আপনি তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন, কারণ ততদিনে তাকে বিশ্বাস করা শুরু করেছেন, তখনই আপনি আবিষ্কার করবেন, তার মধ্যে আপনাকে অনুকরণ করার সেই অভ্যাসটা আর নেই। সে এখন নিজের মতো চলা শুরু করেছে। নিজের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা উপভোগ করতে চাইছে।
এটা কীভাবে কাজ করে? একে বলা হয় স্ট্র্যাটেজিক এমপ্যাথি (কৌশলগত সহমর্মিতা)- উদ্দেশ্যমূলকভাবে সহানুভূতি তৈরি করা। সে আপনাকে অনুকরণ করে, কারণ সে আপনাকে ভালোবাসে কিংবা সে আপনার জন্য কেয়ার (যত্ন) করে- এমনটা কিন্তু নয়। সে আপনাকে অনুকরণ করে, কারণ এর মাধ্যমে দ্রুত আপনার বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে।
এই ছলনা থেকে বাঁচার উপায় কী? ধীরে চলুন। 'প্রথম দেখাতেই প্রেম'- এই নীতি থেকে বের হয়ে আসুন। সত্যিকারের সংযোগ (কানেকশন) তৈরি হতে সময় লাগে দু'জন মানুষের মধ্যে। এর আসলেই কোনো বিকল্প নেই। 'ধীরে চলো নীতি' কেন সাহায্য করবে? কারণ একজন মানুষ খুব বেশিদিন অভিনয় চালিয়ে যেতে পারে না। আপনি অল্প কিছু সময় দুনিয়ার সব মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন, কিংবা অল্প কিছু মানুষকে সারা জীবন বোকা বানিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু সব মানুষকে সব সময় বোকা বানাতে পারবেন না। একসময় না একসময় অভিনয়ের দেয়াল খসে পড়বে। সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
(চলবে...)
Comments