ছোট অস্ত্রের বড় হাত
বাংলাদেশে এখন যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে,তার নাম 'ছোট অস্ত্র'। একসময় বড় বন্দুক মানেই ছিল বড় অপরাধ - গডফাদার, সীমানা সংঘর্ষ বা রাজনৈতিক সংঘাত। এখন চিত্র বদলে গেছে। ছোট অস্ত্র -পিস্তল, রিভলভার, শটগান - এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত, কারণ এগুলো সহজে লুকানো যায়, সহজে বহন করা যায়, আর হত্যার জন্য যথেষ্ট প্রাণঘাতি। তাই এখন বলা যায় - ছোট অস্ত্রের বড় হাত।
আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্য দিবালোকে শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা কেবল একটি খুন নয়; এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁকফোকর স্পষ্ট করে দিয়েছে। এমন জায়গায়, যেখানে নিরাপত্তা থাকার কথা সর্বোচ্চ পর্যায়ে, সেখানে যদি দুই ব্যক্তি মোটরসাইকেলে এসে কাছ থেকে গুলি চালিয়ে বীরদর্পে চলে যেতে পারে - তবে তা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ বার্তা।
এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশের নানা প্রান্তে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি বা আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। চট্টগ্রাম, খুলনা, এমনকি রাজধানী ঢাকাও এর বাইরে নয়। চট্টগ্রামে গত এক বছরে ৩৫ জন খুন হয়েছেন, এর মধ্যে ২২ জন গুলিতে নিহত। খুলনায় ৪১টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ১৫টিতে ব্যবহার হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, পুরান ঢাকায়ও গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটছে প্রায় নিয়মিতভাবেই।
পুলিশের হিসাব বলছে,গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া ১ হাজার ৩৪২টি অস্ত্র এখনও উদ্ধার করা যায়নি। এই অস্ত্রগুলো এখন কোথায়, কার হাতে? পুলিশের প্রতিবেদনেই ইঙ্গিত আছে - এসব অস্ত্রের একটি অংশ অবৈধভাবে বিক্রি হয়ে গেছে এবং সন্ত্রাসীদের হাতে পড়েছে। অর্থাৎ, যে অস্ত্র একসময় আইন রক্ষার জন্য ছিল, সেটিই এখন নাগরিক আতঙ্কের উৎস।
ছোট অস্ত্রের বিপদ এখানেই-এগুলো সহজে লুকানো যায়, কিন্তু প্রভাব ফেলে গভীরভাবে। বড় অস্ত্রের শব্দ শোনা যায়, ছোট অস্ত্রের গুলিতে মানুষ মরে নিরবে। অপরাধীরা তাই এখন ছোট অস্ত্রের দিকেই ঝুঁকছে - খুন, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি - সবখানেই এর আধিপত্য।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ছোট অস্ত্রের ব্যবহার আরও বেড়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো, প্রভাব বিস্তার, বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। এতে নারী, সংখ্যালঘু ও সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভয় বাড়ছে। ভয় আছে, নির্বাচনের মাঠ বন্দুকের আওয়াজে মুখর হয়ে উঠবে - যা গণতন্ত্রের জন্য অশুভ বার্তা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, তারা অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু উদ্ধার অভিযানের শেষে এক-দুটি পিস্তল দেখিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেও মূল অস্ত্র চক্র অক্ষত থেকে যায়। কারণ, এই চক্রের শিকড় রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের ভেতরে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই শিকড় কাটা না যায়, ছোট অস্ত্রের বড় হাত আরও প্রসারিত হবে।
আরও ভয়াবহ হলো, আমরা ধীরে ধীরে সহিংসতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। গুলির শব্দ শুনলে আর মানুষ চমকে ওঠে না। হত্যার খবর এখন কেবল একদিনের সংবাদ -পরদিন ভুলে যাই। এই মানসিক অবক্ষয়ই সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ।
রাষ্ট্র যদি এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, তবে অবৈধ অস্ত্র একদিন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণও নিজের হাতে নিয়ে নেবে। নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই উদ্ধার করতে হবে সেই ১ হাজার ৩৪২টি হারানো অস্ত্র। পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার রোধ, কালোবাজার ধ্বংস, এবং রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সহিংসতা একসময় রাজনীতির অস্ত্র ছিল; এখন এটি সমাজের অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ -রাষ্ট্রের কঠোর আইন প্রয়োগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং নাগরিক সচেতনতা।
ছোট অস্ত্রের বড় হাত যদি এখনই রোধ না করা যায়,তবে এই ছোট অস্ত্রগুলোই বড় ইতিহাস লিখবে - রক্তে রাঙানো, ভয়ংকর এক অধ্যায়।
Comments