শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে প্রাথমিকে অচলাবস্থা
১০ম গ্রেডে বেতনসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত সহকারী শিক্ষকদের ওপর 'পুলিশি হামলার' প্রতিবাদে গতকাল রোববার থেকে দেশ জুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হয়েছে। এতে সারা দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৭টি বিদ্যালয়ের প্রায় ১ কোটি শিশু শিক্ষার্থীর ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে এলেও শিক্ষকরা পাঠদান বন্ধ রেখেছেন। বাধ্য হয়ে ক্লাস না করেই ফিরে যেতে হয়েছে শিশু শিক্ষার্থীদের। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেই হিসেবে মাত্র তিন সপ্তাহ বাকি আছে পরীক্ষার। এমন সময়ে শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামায় এবং সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন অভিভাবকরা।
এদিকে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে কর্মরত সহকারী শিক্ষকদের বর্ধিত গ্রেডে বেতন দিতে বছরে অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় ৮৩১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অতিসম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে লিখিতভাবে এই প্রস্তাব পাঠানো হয়। তার আগে অর্থ বিভাগেও একই ধরনের প্রস্তাব করা হয়। লিখিত প্রস্তাবে ব্যয়ের তথ্যও তুলে ধরা হয়। তিন দফা দাবিতে গত শনিবার থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা। ১৫ নভেম্বরের পর তাদের কর্মবিরতি কর্মসূচিতে যাওয়ার কথা ছিল। তবে অবস্থান কর্মসূচির প্রথম দিনে শাহবাগে 'কলম সমর্পণ' কর্মসূচিতে পুলিশের হামলার ঘটনায় তা এগিয়ে আনেন শিক্ষকরা। শহিদ মিনারের কর্মসূচি থেকে তারা 'পুলিশি হামলার' প্রতিবাদে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন।
আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফরম প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমরা কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচিতে অনড়। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি চালাব। তিন দফা দাবি বাস্তবায়ন না করা, শাহবাগে নিরীহ শিক্ষকদের ওপর অতর্কিত হামলা, রাবার বুলেট, জলকামান, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে শত শত শিক্ষককে আহত করার দায় হিসেবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি।' ১০ম গ্রেডে বেতন ছাড়াও প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বাকি দুটি দাবি হচ্ছে চাকরির ১০ ও ১৬ বছরে উচ্চতর গ্রেড পাওয়া নিয়ে জটিলতা নিরসন এবং শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির নিশ্চয়তা।
তিন দাবি আদায়ে কাফনের কাপড় হাতে গতকাল রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শপথ নিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কাফনের কাপড় হাতে তারা শপথ নেন, '১০ম গ্রেড এবং শতভাগ পদোন্নতি ছাড়া ফিরে যাবেন না।' শপথ শেষে শিক্ষক নেতা আনিসুর রহমান আনিস বলেন, একই যোগ্যতা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১০ম গ্রেড পাচ্ছে। কিন্তু আমরা পাচ্ছি ১৩তম গ্রেড। বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট হয়েও আমাদের দিনমজুরের অর্ধেক বেতনে চাকরি করতে হয়।
প্রসঙ্গত, আন্দোলনরত 'প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ' মোর্চায় রয়েছে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি (কাশেম-শাহিন), বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি (শাহিন-লিপি), বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতি ও সহকারী শিক্ষক ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন পরিষদ।
এক বছরে দুই দফা কর্মবিরতি : এবারই প্রথম নয়, চলতি বছর আরও এক বার টানা কর্মবিরতি পালন করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। গত ৫ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত সারা দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মদিবসে এক ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন তারা। এরপর ১৭ মে থেকে দুই ঘণ্টা এবং ২১ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত আধাবেলা কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা। ২৬ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করেন সহকারী শিক্ষকরা। টানা চার দিন কর্মবিরতির পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের আশ্বাসে ১ জুন থেকে ক্লাসে ফিরে যান তারা। তবে সেই আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। ফলে আবারও রাস্তায় নেমেছেন তারা।
১১তম গ্রেড থেকে আবার ১০ম গ্রেডের দাবি কেন তোলা হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের নেতা আবুল কাশেম বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার একটি নতুন পে-স্কেল করছে। একটি কমিশন এটা নিয়ে কাজ করছে। পে-কমিশনের কাছে প্রাথমিকের শিক্ষকরা তাদের দাবি জানালেও তাতে পাত্তা দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে শিক্ষকরা পে-কমিশনের কার্যক্রম সামনে রেখে ১০ম গ্রেডের দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছে।'
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দিতে সুপারিশ করেছি। এটি অর্থ মন্ত্রণালয় যদি অনুমোদন করে, তাহলে তারা ১১তম গ্রেড পাবে। এর বাইরে আমাদের হাতে আর কিছু নেই।'
শিক্ষকদের অন্য অংশের আল্টিমেটাম: এদিকে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের আরেকাংশ 'প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের' ব্যানারে একাদশ গ্রেডে বেতন, উচ্চতর গ্রেড নিয়ে জটিলতা নিরসন ও শতভাগ পদোন্নতি নিশ্চিত করতে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছেন। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী ২৩ ও ২৪ নভেম্বর অর্ধদিবস কর্মবিরতি, ২৫ ও ২৬ নভেম্বর পূর্ণদিবস কর্মবিরতি এবং ২৭ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। এই সময়ের মধ্যে দাবি আদায়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি বা ঘোষণা না এলে পরীক্ষা বর্জন এবং ১১ ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করবেন তারা। এ মোর্চাভুক্ত সংগঠনগুলোর শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করছেন না। তবে এদের সংখ্যা সীমিত বলে দাবি করেন শহিদ মিনারে অবস্থান নেওয়া শিক্ষকরা।
পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ: সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডসহ তিন দফা দাবির আন্দোলনে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি। এছাড়া আন্দোলন কর্মসূচিতে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ পিটিআই কর্মকর্তা সমিতি এবং বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল এই তিনটি সংগঠন সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডসহ তিন দফা দাবির বিষয়ে যৌক্তিক সমাধান দাবি করেছে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের ওপর পুলিশি হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে তারা।
Comments