তারেক রহমানের নামে অপপ্রচার নিয়ে যে জবাব দিলো বিএনপি মিডিয়া সেল
ইদানীং তারেক রহমান ও বিএনপিকে আওয়ামী বয়ানে খাম্বা তারেক বা খাম্বা দল বলে পুনরায় ব্যাশিং করে একটা বিশেষ গ্রুপ নেগেটিভলি প্রেজেন্ট করছে। এর জবাবে নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট শেয়ার করেছে বিএনপি মিডিয়া সেল। মূল পোস্টটি মুহাম্মদ মোতাহার হোসেন নামক একজনের। পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
কয়েকদিন আগে আমারই এক লেখায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের শিবিরের পদধারী নেতা, আমার খুবই প্রিয় সুহৃদ, এক সময়ের ঘনিষ্ট সহকর্মী 'খাম্বা তারেক' বলে একটা কমেন্ট করে। তার মতই তার দলের এমন বহু কর্মী সমর্থক আছে যারা এখন এই আওয়ামী বয়ানে ভর করেছে। বিশেষ করে রেডিট এ অনেকেই এই নিয়ে প্রশ্ন করছে আর সেই সব প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা মনগড়া বায়বীয় মতামত দিচ্ছে।
আসলেই কি তারেক রহমান খাম্বা প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছিলেন?
BPDB, REB ও IMED এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১-২০০৬ সময়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের বিদ্যুৎ ডিস্ট্রিবিউশনের উদ্দেশ্যে ৮৭৫ কোটি টাকার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (লাইন, ট্রান্সফর্মার, ইনস্টলেশন) স্থাপন প্রকল্প (ADP) হাতে নেয়া হয়েছিল।
ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে সেই প্রকল্পের ৫১১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার অর্থাৎ ৫৮% কাজ পেয়েছিল আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী কাজী শহিদের জেমকন গ্রুপ। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন প্রকৌশলী রেজাউল করিমের কনফিডেন্স গ্রুপ পায় ১১৯ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকার, কনটেক গ্রুপ পায় ৮৫ কোটি ৪ লক্ষ টাকার কাজ, আর তারেক রহমনের বন্ধু (কথিত) গিয়াস উদ্দীল আল মামুনের কোম্পানি পায় ১০২ কোটি ১০ লক্ষ টাকার অর্থাৎ মাত্র ১১.৭ % কাজ। (BPDB Annual Report 2005; REB Annual 2006)
২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরের সচল সংযোগের সংখ্যার রেকর্ড থেকে দেখা যায়, ২০০১ সালে ছিল ৮৪ লক্ষ ৭০ হাজার, ২০০২ সালে ৯৪ লক্ষ ৩০ হাজার, ২০০৩ সালে ১ কোটি ৪২ হাজার, ২০০৪ সালে ১ কোটি ১৪ লক্ষ ১০ হাজার, ২০০৫ সালে ১ কোটি ২৩ লক্ষ ২০ হাজার এবং ২০০৬ সালে ১ কোটি ৩৩ লক্ষ ৬০ হাজার সংযোগ চলমান ছিল। অর্থাৎ প্রতি বছরেই ৫-৬% হারে সংযোগের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছিল। (BPDB Data Book 2005; REB Annual Report 2006; World Bank BETS Survey 2006)
এই সংযোগ কি কাগজে কলমে ছিল নাকি বাস্তবিক তা প্রমাণ করার জন্যে আমরা এই সময়কালে বিদ্যুতের নেট উৎপাদন রেকর্ড সংগ্রহ করেছি। সেখানে ২০০১ সালে ছিল ১৫,৪৭৭ (GWh), ২০০২ সালে ১৬,৪৭৭ (GWh), ২০০৩ সালে ১৭,৯১৯ (GWh), ২০০৪ সালে ১৯,৩৬৬ (GWh), ২০০৫ সালে ২১,৪০৮ (GWh), এবং ২০০৬ সালে ২২,৯৭৮ (GWh)। এখানে দেখা যায় উৎপাদন বৃদ্ধির হার গড়ে ৭%। (BPDB Annual Report 2006; IAEA CNPP 2006; World Bank Energy Sector Review 2007)
অর্থাৎ শুধুমাত্র পিলার বসিয়ে কাগুজে সংযোগের বায়বীয় তথ্য দেখানো হয়নি বরং উৎপাদন রেকর্ডও সংযোগ বৃদ্ধির অনুপাতে প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছিল।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এই উৎপাদন করার জন্যে খরচ বেশি দেখিয়ে টাকা লুটপাট করা হয়েছিল। তা না হলে বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না কেন?
আমরা যদি একই সময়কালের কিলোওয়াট প্রতি উৎপাদন খরচ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে দেখা যায়, ২০০১ সালে প্রতি কিলোওয়াট উৎপাদন খরচ ছিল ০.৮৯ টাকা যখন তেলের দাম ছিল ২০-২৫ টাকা, ২০০২ সালে ১.১৮ টাকা তেলের দাম ২২-২৭ টাকা, ২০০৩ সালে ১.৪২ টাকা তেলের দাম ২৫-৩০ টাকা, ২০০৪ সালে ১.৩৭ টাকা তেলের দাম ৩০-৩৫ টাকা, ২০০৫ সালে ১.২৭ টাকা তেলের দাম ৩৬ টাকা, ২০০৬ সালে ১.২৭ টাকা তেলের দাম ৩৫-৩৮ টাকা।
এখানে দেখা যাচ্ছে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলেও উৎপাদন খরচ কমে যাচ্ছে। এর কারন ছিল তখন গ্যাসের দাম ৭২-৭৪ এর মধ্যে ফিক্সড ছিল এবং উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার ছিল ৭০-৮০%। (BPDB Annual 2006; Petrobangla Report 2005; World Bank PSIA 2007)
এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, লাইন বৃদ্ধির হার, গিগাওয়াট আওয়ার উৎপাদনের পরিমান, কিলোয়াট প্রতি উৎপাদন খরচ এতটাই রিলেটেড যে ম্যনুপুলেটেড তথ্যের সন্নিবেশ ঘটিয়ে অর্থ লোপাটের কোন প্রমাণ এ থেকে বের করা যায় না।
২০০১-২০০৬-এ REB-এর অধীনে ৫০% গ্রাম বিদ্যুতায়িত হয়েছে। World Bank-এর PPAR (Report No. 88546, ২০১৪) এবং IAEA CNPP রিপোর্ট (২০০৬) এ কোন অপ্রয়োজনীয় অকেজো খাম্বার উল্লেখ নেই; পরিবর্তে, প্রকল্পের আউটকামকে "স্যাটিসফ্যাক্টরি" এবং "লস মিনিমাইজড" বলে উল্লেখ করে।
World Bank এর Global Electricity Indicator চার্ট অনুযায়ী, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫% বিদ্যুতের কাভারেজে ছিল, ২০০৬ সালে সেই কাভারেজ পৌঁছায় ৫০.৫%। (World Bank WDI Database; Global Electricity Review 2007)
এবার আমরা ভিন্ন এঙ্গেলে দেখি, পিলারের দাম বেশি দেখিয়ে অর্থ লুটে নেয়া হয়েছিল কি না।
REB -র স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ডিস্ট্রিবিউশান পিলারের হাইট ভোল্টেজ ভেদে ভিন্ন হয়। আমরা হাউসহোল্ডের ভোল্টেজ ধরে হিসাব করবো। সেক্ষেত্রে ২২০-৪৪০ ভোল্টের লাইনের পিলার হাইট ৮-১১ মিটার হয়।
REB Rural Line Design Standard অনুযায়ী লাইন ও পিলারের ধরনের গড় অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ২৫-৩০ টি পিলার স্থাপন হয়। (REB Technical Specification for 33/11 kV & LT Line Construction (PBS Instructions), BPDB/REB Joint Survey 2005: Average 26 poles/km in rural areas)
২০০৯ সালে ডেইলি স্টার খাম্বা নিয়ে একটা রিপোর্ট করে। সেখানে তারা অভিযোগ করে R-44 অর্থাৎ ১০.৬ মিটার পিলার ১৫,৫০০ টাকায় কেনা হয়েছিল যার বাজারদর ছিল মূলত ৬,৪২৬ টাকা। R-41 (৯ মিটার) পিলার ৮,৫৭৫ টাকায় যার বাজারমূল্য ৪,৪৬২। অর্থাৎ তারা অভিযোগ করে প্রায় ২.৫ গুন বেশি দামে পিলার কেনা হয়েছিল।
আমরা প্রথমে তাদের রেফারেন্স অনুযায়ী ৬,৪২৬ টাকাকেই সঠিক ধরে হিসাব করবো। হিসাবের জন্যে আমরা ২০০১-২০০৬ সালের মোট নতুন লাইনের কিলোমিটার খুঁজে বের করবো। REB এর রিপোর্ট মতে ২০০১ সালে সংযোগ ছিল ৮৪.৭ লক্ষ এবং ২০০৬ সালে ১ কোটি ৩৩.৬ লক্ষ অর্থাৎ ৫ বছরে সংযোগ বাড়ে ৪৮.৯ লক্ষ।
REB-এর অফিসিয়াল ম্যানুয়াল (PBS Instruction 100-45, পৃ. ৩০+) প্রতি নতুন সংযোগে গড়ে ১৭৫ মিটার লাইন লাগে। সে হিসাবে ৪৮.৯ লক্ষ নতুন সংযোগে ৮৫,৫৭৫ কিলোমিটার নতুন লাইন।
একটি অসমর্থিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রেফারেন্সবিহীনভাবে ৬০,০০০ কিলোমিটার বলা হলেও আমরা ৮৫,৫৭৫ কিলোমিটারের এর জায়গায় সেই তথ্যই গ্রহণ করছি।
ডেইলি স্টারের উল্লেখ করা বাজারদর ৬,৪২৬ টাকা হিসাবে ৮৭৫ কোটি টাকায় ১৩ লক্ষ ৬১ হাজার ৬৫৫ টি পিলার পিলার ক্রয় সম্ভব। গড়ে প্রতি কিলোমিটারে ২৫ টি পিলার ধরলে মোট কাভার হয় প্রায় ৫৪,৪৬৬ কিলোমিটার নতুন সংযোগ। এই দামে পিলার কিনে থাকলে এবং বাজেটের পুরোটাই পিলার ক্রয় করলে আমাদের রেজাল্ট প্রায় কাছাকাছি।
এবার আমরা ডেইলি স্টারের উল্লেখ করা সবচেয়ে ছোট পিলারের বাড়তি দাম ৮,৫৭৫ টাকা ধরি। মানে ডাবল দামে কিনে তারেক রহমান টাকা নিয়ে গেছেন। এই অভিযোগ করা দামে ৮৭৫ কোটি টাকায় পিলার কেনা যায় ১০ লক্ষ ২০ হাজার আর সংযোগ কাভার হয় ৪০,৮১৪ কিলোমিটার।
তাহলে বাকি ১৯,০০০+ কিলোমিটার লাইনের পিলার কি কোম্পানিগুলো ফ্রী তে বসিয়েছে? ১৫,৫০০ টাকার হিসাবে গেলে অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যাবে কোম্পানিগুলোর। জেমকন গ্রুপ সেই আমলেই দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা।
ডেইলি স্টারের সেই অভিযোগকে সত্য ধরলে পিলার বসানোর পর ট্রান্সফরমার কেনার টাকা থাকে না। কিন্তু আমরা পুর্বেই দেখেছি বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্টন আনুপাতিক হারেই বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাহলে তারেক রহমান কিভাবে হাজার কোটি টাকা অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন? মানে কাজীর গরু চুরির গপ্পো মিডিয়ার প্রপাগান্ডায় ছিল বাস্তবে যার পুরোটাই অসম্ভব।
তথ্য এখন ওপেন। আপনি একটু ভাল করে খুঁজলেই বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও রিলেটেড প্রতিষ্ঠানগুলোর রিপোর্ট পেয়ে যাবেন। যে প্রকল্পের বাজেট ৮৭৫ কোটি টাকা সেই প্রকল্প থেকে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ ভিত্তিহীনই নয় বরং হাস্যকর।
অন্যদিকে প্রকল্পের বাস্তবায়নে দেশব্যাপী ইলেক্ট্রিক পোল স্থাপন করার প্রমাণ অভিযোগের ভিতরেই পাওয়া যায়। বিষয়টা এমন নয় যে কাগজে পিলার স্থাপন দেখিয়ে টাকা লুটে নিয়েছিল কিন্তু বাস্তবে কিছুই বসানো হয়নি।
শেখ হাসিনাও পালানোর সময় এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের মগবাজার-মালিবাগ-কমলাপুর রুটের পিলার দাঁড় করানো ছিল। উপরে স্প্যান বসিয়ে কাজ শেষ করে যেতে পারেনি সে। তাহলে কি হাসিনারেও খাম্বা ডাকা উচিত? মিডিয়াগুলো কি নিউজ করবে 'হাসিনা দ্যা এলিভেটেড খাম্বা' টাইটেলে?
Comments