আগুনের ছাইয়ে বাণিজ্যের শিক্ষা
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড শুধু আমদানিকারকদের আর্থিক ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিমা খাতের এক গভীর সংকটকেই নগ্নভাবে উন্মোচন করেছে। কয়েক ঘণ্টার আগুনে পুড়ে গেছে কোটি কোটি টাকার পণ্য, আর সেই ছাইয়ের ভেতর থেকে উঠে এসেছে এক কঠিন প্রশ্ন - আমাদের ব্যবসায়িক প্রস্তুতি কতটা পরিপূর্ণ, আর ঝুঁকি মোকাবিলার জ্ঞান কতটা সচেতন?
বিমা আছে, কিন্তু সুরক্ষা নেই
এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ আমদানিকারকই বিমা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা এখন হতবাক। কারণ বিমা কোম্পানিগুলো বলছে, তাদের পলিসি অনুযায়ী এই ক্ষতি কাভার করে না। কারণ বিমা করা হয়েছিল "Air Risk Only" শর্তে। অর্থাৎ, বিমানে থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটলে বিমা কার্যকর, কিন্তু বিমান থেকে নামানোর পর, যখন পণ্য কার্গো ভিলেজের গুদামে অবস্থান করছে -সেই সময় কোনো ক্ষতি হলে তা এই বিমার আওতায় পড়ে না।
এই 'Air Risk Only' বা সীমিত বিমা শর্ত বেছে নেওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল কম প্রিমিয়াম। ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন, যতক্ষণ না পণ্য দেশে আসে, ততক্ষণই বড়ো ঝুঁকি। কিন্তু বাস্তবতা প্রমাণ করেছে- ঝুঁকি বিমানেই শেষ হয় না; বরং শুরু হয় মাটিতে নামার পর। গুদাম, কাস্টমস প্রক্রিয়া, পরিবহন-প্রত্যেক ধাপেই অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় অজ্ঞতা
বাংলাদেশে এখনো বাণিজ্যিক বিমাকে অনেক ব্যবসায়ী "আনুষ্ঠানিকতা" হিসেবে দেখেন, প্রকৃত সুরক্ষা হিসেবে নয়। বেশিরভাগ আমদানিকারক বিমা চুক্তির শর্ত ভালোভাবে পড়েন না, বুঝে নেন না বা পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। এ কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলোকে সীমিত কভারেজের বিমা করতে হয়। ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে দেখা যায়,পলিসির ছোট একটি ধারা পুরো দাবিকে বাতিল করে দেয়।
এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক ভুল নয়, বরং আর্থিক পরিকল্পনার ব্যর্থতা। এবং এই ব্যর্থতা আমাদের অর্থনীতির জন্য এক বড়ো সতর্কবার্তা। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যদি অগ্নিকাণ্ডে নাশকতার প্রমাণ মেলে, তাহলে বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি অস্বীকার করার সুযোগ থাকবে।
শিক্ষা ও করণীয়
এই ঘটনাটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি খাতের জন্য সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হলো -ঝুঁকির প্রকৃতি বুঝে সঠিক বিমা বেছে নেওয়া। "Warehouse to Warehouse" বা "Air All Risk" ধরনের বিমা পলিসি তুলনামূলক ব্যয়বহুল হলেও, এতে পণ্যের প্রতিটি ধাপ-পরিবহন, আনলোডিং, গুদামজাতকরণ - সবই সুরক্ষিত থাকে।
এছাড়া বিমা খাতে একটি জাতীয় সচেতনতা কর্মসূচি প্রয়োজন। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো যেমন এফবিসিসিআই, আমদানিকারক সমিতি বা চেম্বারগুলোকে বিমা জ্ঞানের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা উচিত।
বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলোয় বিমাকে দেখা হয় ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে, সেখানে আমাদের দেশে এটি এখনো "দস্তাবেজে থাকা কাগুজে নিরাপত্তা"।
কার্গো ভিলেজের আগুন কেবল পণ্য পুড়ায়নি -পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বিমা সচেতনতার ভ্রান্ত ধারণা। বিমা থাকলেই যে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় -তা নয়। করতে হবে পূর্ণ বিমা।
সঠিক জ্ঞান, সতর্কতা ও দায়িত্বশীল নীতি গ্রহণই পারে বাণিজ্যের এই অগ্নিকুণ্ড থেকে ভবিষ্যতের নিরাপদ পথ তৈরি করতে।
Comments