আনোয়ার হোসেন : ফটোগ্রাফি যার আত্মজীবনী

'হে বঙ্গ তোমার মুখ নিবিড় ফটোজেনিক বলে
সবাই তুলতে চায় ছবি নানা পোজে, কেউ চায়
নামুক চুলের ঢল অমল শ্যামল গ্রীবা বেয়ে,
কেউবা টিপের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। কস্তাপেড়ে
শাড়িতে তোমাকে খুব মানাচ্ছে সম্প্রতি ভেবে কেউ
ক্যামেরা বাগায় পটু ব্যগ্রতায়, ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক।
মাইরি বিষম তাক লেগে যায় কেরদানি দেখে,
আমি তো তুলি না ফটোগ্রাফ কোনো, দেখি শুধু দেখি'।
আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন তার 'দ্য বাংলাদেশ ইমেজ' শিরোনামের ছবির বইটি শুরু করেছেন কবি শামসুর রাহমানের 'হে বঙ্গ' কবিতার এই পংক্তিগুলো দিয়ে। মনে করি, কবিতাটি এই বইয়ে কখনো ছিলই না। এবার আমরা যদি এই বইয়ের ছবিগুলো আর কবিতাটি পাশাপাশি রাখি—আমাদের মনে হবে আনোয়ার হোসেনের ছবিগুলো দেখেই যেনো কবি তার অনবদ্য কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই কবিতার প্রতিটি শব্দ, দৃশ্যকল্প ও বর্ণনা হুবহু মিলে যায় ছবিগুলোর সঙ্গে। কবিতাটি হয়ে ওঠে ছবিগুলোর ক্যাপশন! এই সংযোগ কি কাকতালীয়? তা হয়তো নয়, হলে কি আর ঠিক এই কবিতাটিই বেছে নিতেন আলোকচিত্রী? তিনি যখন বাংলাদেশের ছবি তোলেন—তখন তিনি তো আসলে ক্যামেরার মাধ্যমে ওই কবিতার মর্মবাণীই আমাদের সামনে হাজির করেন, কবিতাটিকে শরীর দেন। একইভাবে তিনি দৃশ্যগতভাবে মূর্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ ও আল মাহমুদের বাণীকে।

জীবনে নানা ধরনের ফটোগ্রাফি আনোয়ার হোসেন করেছেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট, সুরিয়াল, কনসেপ্চুয়াল, স্টিললাইফ, ন্যুড…। কিন্তু ওই বাংলাদেশ—তার কাব্যিক সৌন্দর্য, সরলতা, অনুভূতি, অন্তর্নিহিত শক্তি ও প্রেরণা থেকে তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন হননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছুটে গেছেন বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের কাছে। মাহমুদুল হোসেন ও মানজারে হাসীনকে দেয়া সাক্ষাৎকার তিনি বলেছেন, 'আমি তো তাড়িত ছিলাম মানুষ দ্বারা, মানে মানবিক অনুভূতি নিয়ে, সাধারণত মানুষই আমার ছবির বিষয়।…বিশেষ করে বিভিন্ন স্তরের মানুষের যে দ্বন্দ্ব, একটা ফ্রেমে তা ধরে রাখতে আজ পর্যন্ত আমার খুব মজা লাগে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনজীবন'।
তার মতে, একেক দেশের কাজ একেক ধরনের হয়। ফরাসিদের কাজের মধ্যে যেমন তাদের চিন্তা-ভাবনার ছাপ থাকে, তেমনি বাংলাদেশের কাজেও এই দেশের মুখচ্ছবি থাকা উচিত। আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও প্রকৃতি অন্যকোনো দেশের সঙ্গে হুবহু মিলবে না। কিছু মিল থাকতে পারে। নিজেদের নিজস্বতা জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের মতো করে 'গ্লোবালাইজ' করার বিপক্ষে ছিলেন এই দৃশ্যশিল্পী।
ক্ল্যাসিক স্টাইলে তোলা তার ছবিগুলোতে মানবিকতা এবং মানবিক মর্যাদা জ্বলজ্বলে। ছবির এই বৈশিষ্ট্যের জন্য আনোয়ার হোসেন প্রশংসিত হওয়ার চেয়ে বঞ্চিতই হয়েছেন বেশি। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আলোকচিত্রীরা তাকে বলেছেন তারা সেই ছবিই তোলেন যা পশ্চিমারা চায়। এমন ছবি যা পুরস্কার পাবে। এই বাস্তবতা সম্পর্কে আনোয়ার হোসেনের মতো ওয়াকিবহাল খুব কম বাংলাদেশি আলোকচিত্রী ছিলেন—তারপরও তিনি গা ভাসাননি। তিনি নিজের পছন্দের ছবিই তুলে গেছেন। আর এজন্যই তিনি বলতে পারেন, 'আমার ফটোগ্রাফি এক অর্থে আমার আত্মজীবনী'। তিনি মনে করতেন, সৃষ্টির প্রধান উপাদান অনুপ্রেরণা—যা শিল্পীর একেবারে ভেতর থেকে আসে। বাইরের অনেক কিছু তাকে টেকনিক্যালি সাহায্য করতে পারে মাত্র। কিন্তু দিনশেষে সৃষ্টিশীলতার জন্য অনুপ্রেরণা পেতে ছুটে যেত হয় মাটির কাছেই।
সাইফুল হক অমি ও মুনেম ওয়াসিফকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছেন, 'যখন যে জিনিসগুলো আমার ভালো লাগে বা যে জিনিসগুলোকে আমি ভালোবাসি এগুলোর ছবি তুলবো। কোন রকম ধান্দা, যেমন এটা বিক্রি করবো বা এটা নিয়ে বই করবো বা এটা পুরস্কার পাবে এসব উদ্দেশ্য ছাড়াই'। ছবি বিক্রি করে কতো টাকা আয় হলো তা দিয়ে যেখানে আলোকচিত্রীকে বিচার করা হয় এবং যেখানে কাজের বা শিল্পীর মর্যাদা নেই সেখান থেকে বহুবার নিজেকে অবলীলায় বিচ্ছিন্ন করেছেন 'ডিগনিটি'র পূজারী আনোয়ার হোসেন। বারবার বলেছেন, 'তুমি সৃষ্টি সেটাই করবে যেটার তাগিদ হৃদয়ের ভেতর থেকে আসবে'। নিজের দিকে না চেয়ে অন্যের চাহিদা পূরণের যে চেষ্টা তাকে তিনি অসদুপায় মনে করতেন। শিল্পীর কাজ অন্যের মনোরঞ্জন করা নয়—তার কাজ 'নিজের ভালোবাসার ফসল'কে একটি রূপ দেয়া।

১৯৪৮ সনে পুরান ঢাকার 'বস্তি'তে জন্ম নেয়া আনোয়ার হোসেন প্রায় ৫০টি বছর ফটোগ্রাফি করেছেন। তার এই যাত্রা কখনোই সরলরৈখিক ছিল না। ছোটবেলায় ছবি আঁকার শখ ছিল। কিন্তু দারিদ্র তাকে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে দেয়নি। ১৯৬৫ সনে ম্যাট্রিকে খুব ভালো ফলাফল করলেন। বড় আশা নিয়ে ভর্তি হলেন বুয়েটে। কিন্তু কিছুদিন পরই বুঝলেন, স্থাপত্য 'মনের কথা বলে না'। তারপরই মনের কথা বলতে ক্যামেরাকে বুকে তুলে নিলেন। এমন উত্থান-পতন প্রায় সব শিল্পীর জীবনেই থাকে। একজন শিল্পীর জীবনে এই ভাঙাগড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তার শিল্পযাত্রার চড়াই-উৎরাই। একজন উঁচুদরের শিল্পীই প্রতিনিয়ত নিজের কাজের সঙ্গে 'এক্সপেরিমেন্ট' করেন, নিজের স্টাইল ভাঙেন,ধ্যানধারণা ভাঙেন এবং পদে পদে নিজেকে চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্ন করেন। আনোয়ার হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের হাতেগোনা তেমন কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে উজ্জ্বলতম। এজন্যই আলোকচিত্রী ও শিক্ষক শহিদুল আলম আনোয়ার হোসেনের কর্মকে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফির জন্য একটি 'টার্নিং পয়েন্ট' বলে উল্লেখ করেছেন।
শেষ দিকে তো তিনি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে চাইছিলেন। চাইছিলেন, আরো জটিল বিষয়বস্তুকে বুঝতে এবং তাকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করতে। এই সহজ বা সরল বলতে তিনি বুঝতেন, আড়ম্বরহীনতা। তার এই উপলব্ধির বহির্প্রকাশ 'ইন্ট্রোস্পেকশন' (আত্ম-উপলব্ধি) সিরিজের ছবিগুলো। এই সিরিজটি সম্পর্কে আলোকচিত্রী ও শিক্ষক মুনেম ওয়াসিফ যথার্থই বলেছিলেন, 'গ্রাম বাংলার আদর্শ ছবি নির্মাণ থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আনোয়ার হোসেন তাক ঘুরিয়েছিলেন অন্য দিকে। ভাঙতে চেয়েছিলেন নিজের ধরন, বলতে চেয়েছিলেন অন্য গল্প।…এই ছবিগুলো সম্ভবত বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে আধুনিক কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম'। আনোয়ার হোসেন বলতেন, আলোকচিত্র শিল্পের প্রথম পর্যায়ে তাকে রিয়ালিজম তাড়িত করত। সেই রিয়ালিজম তাকে শেষতক টেনেছিল ঠিকই, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতা, বিষয়বস্তু এবং সময় বদলে যাওয়ার কারণে তার মধ্যে পরিবর্তন আসে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার কাজেও পরিবর্তন দেখা যায়। তার এই পরিবর্তনের আরেকটি নির্দশন 'নার্সিসিজম' সিরিজ। এই সিরিজের মাধ্যমে তিনি নিজেকে খুঁজে বেরিয়েছেন।
সম্ভবত পশ্চিমা চিন্তাধারা তাকে প্রভাবিত করেছিল বলেই তিনি বুঝেছিলেন, ভাঙাগড়াতেই আনন্দ। এই ভাঙাগড়ার খেলাই শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে। এদিক থেকে তার সঙ্গে চিত্রশিল্পী সুলতানের খানিকটা মিল আমরা খুঁজে পাই। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে সুলতান ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন এবং পশ্চিমা শিল্পকলাকে গভীরভাবে অনুধাবনের সুযোগ পান। পাশ্চাত্য শিল্পকলা তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে—বিশেষ করে ইউরোপীয় রেনেসাঁ। তেমনিভাবে আমরা দেখি, ১৯৯১ সনে আনোয়ার হোসেন শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে খ্যাত ফ্রান্সে বসবাস শুরু করেন। তার আগে ১৯৭৭ সনে ভারতের 'ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউ অব ইন্ডিয়া' থেকে সিনেমাটোগ্রাফির ওপর করেন পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা। এভাবেই তার দৃষ্টির পরিসর বাড়তে থাকে। তিনি পান, 'বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া'। শহিদুল আলমও তাই মনে করেন, তার মতে, 'আনোয়ার পশ্চিমা ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তিনি একদিকে ধ্রুপদী শিল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, অন্যদিকে সমকালীন ধারার প্রভাবও তার কাজে পড়েছে'। সুলতানের মতো তাকেও শহরের চেয়ে বাংলার গ্রাম বেশি টানতো। সুযোগ পেলেই কাঁধে ক্যামেরা ফেলে শরীয়তপুরে নিজ গ্রামে ছুটে যেতেন। সুলতানের মতো তিনিও যে তার প্রধান সাবজেক্ট করেছিলেন দেশের মানুষ ও নিসর্গকে এবং তার মানুষও ভুখা-নাঙ্গা নয়—বরং স্বমহিমায় উদ্ভাসিত—সে আলোচনা আমরা ইতোমধ্যে করেছি।

শহিদুল আলম প্রসঙ্গে বলে রাখি, সম্ভবত শহিদুল আলমের ছবিতেই প্রথম—রাজনীতি ছবিতে ঘটনা হিসেবে নয়—এসেছে রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে। কিন্তু তার পূর্ববর্তী গোলাম কাসেম ড্যাডি, মনজুর আলম বেগ, আমানুল হক, নাইব উদ্দিন আহমেদ, ড. নওয়াজেশ আহমদ, আনোয়ার হোসেন প্রমুখের ছবিতে রাজনৈতিক বক্তব্য সরাসরি আসেনি—এসেছে ঘটনার বর্ণনা বা গল্প রূপে। মুক্তিযুদ্ধ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী ছবিগুলো বাদ দিলে, আনোয়ার হোসেনের শুরু দিকের ছবিতে একটি সহজিয়া ব্যাপার সবার চোখেই ধরা পড়ে। এই ধারাটিকে বাংলাদেশে ফটোগ্রাফির 'ক্ল্যাসিক্যাল ধারা' বা 'রোমান্টিক ধারা' বলা যায়—ষাটের দশকের গোড়ার দিকে জোরেশোরে যার শুরুটা করেছিলেন গোলাম কাসেম ড্যাডি ও মনজুর আলম বেগ। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে নওয়াজেশ আহমদ, বিজন সরকার, আনোয়ার হোসেনই সম্ভবত প্রথম সেই ধারা থেকে একটু একটু করে সরে আসা শুরু করলেন। তারা ছবি তোলা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করেন। তারা দৃশ্যের হুবহু প্রতিলিপি করার বিরোধিতা করে আলোকচিত্রকলাকে কেটেছেঁটে—তার আরো গভীরে যেতে চাইলেন।
আনোয়ার হোসেন ঐহিহ্যবাহী ধারা থেকে অনেকটা সরে এলেও—তিনি ফটোগ্রাফির মাধ্যমে 'অ্যাক্টিভিজম' করার দিকে যাননি। কারণ ছবি দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের আশা তার ছিল না। যদিও তিনি জাতীয় ও বিশ্বরাজনীতি সচেতন ছিলেন। তিনি কেন ছবি তুলতেন তা ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি। আর কেন তিনি ভিজ্যুয়াল মাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেননি তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন, কারণ তিনি 'স্লোগানধর্মী শিল্পে' বিশ্বাস করতেন না। তার মতে, 'এটা রাজনীতির ব্যাপার, এটা ফিলসফির বিষয়, এটা কিছুটা ধর্মের ব্যাপার, আমি সব সময় কেন যেন তথাকথিত আশাবাদী…লড়াকু ব্যাপারটা সে কারণে আমার কাজে আসেনি। আমি নিজেও বিশ্বাস করি না।…আমার রাজনীতি বা আমার প্রতিবাদ যদি হয় সেটা আমার কাজের মাধ্যমে'।
নিঃসন্দেহে তার মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো রাজনৈতিক। কিন্তু ছবিগুলোতে কি রাজনীতি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে? তিনি কি আদৌ প্রকটভাবে ধরতে চেয়েছিলেন? মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আসলে এই জনযুদ্ধের 'স্পিরিট' ও শক্তির জায়গাটা খুঁজে বেরিয়েছেন। সেসময় আনোয়ার হোসেন বুয়েটে স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থী। এই তরুণ ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। এককথায় বললে, তার মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোতে আমরা দেখি বীরত্বগাঁথা। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবেই দেখেছেন। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে না হলেও—তরুণ এই মুক্তিযোদ্ধা কাঁধে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে প্রতিদিন সাইকেলে করে বেরিয়ে পড়তেন। ছবি তোলার পাশাপাশি গ্রামের মানুষকে দেশাত্মবোধক গান শেখাতেন এবং রাতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনানোর ব্যবস্থা করতেন।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের একটি মন্তব্য দিয়ে আনোয়ার হোসেনের আলোকচিত্র নিয়ে আলোচনার যবনিকা টানতে চাই। তিনি বলেছিলেন, 'কোনো একটা পেইন্টিং বা একটা ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়ে চট করে দেশ এবং কালের সঙ্গে এর সম্পর্ক, কৃষ্টি, জীবনবোধ, আলোকিত চেতনা—এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি আমি ধরতে পারি না। আমি একটা জিনিস শুধু খুবই আবছাভাবে ধরতে পারি—প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সন্তানদের সৌন্দর্য সৃষ্টির অলৌকিক ক্ষমতা কি সেই বিশেষ পেইন্টিং বা ফটোগ্রাফে ধরা পড়েছে? আনোয়ার হোসেন এই কাজটি করতে পেরেছেন। এইটাই তাঁর বিশেষত্ব'।
আনোয়ার হোসেন একজন একাধিকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফারও। তার এই দিকটিতে একটু আলো না ফেললেই নয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির সিনেমায় ক্যামেরার ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'সত্যিকারের চলচ্চিত্রে ক্যামেরাকে একটি উড়ন্ত লেন্সের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। চরিত্রগুলো ক্যামেরার অস্তিত্ব ভুলে বাস্তবানুগভাবে চলাফেরা ও কথোপথন করে যাবে আর ক্যামেরা উড়ন্ত লেন্স হয়ে বিভিন্ন চরিত্রের অর্থপূর্ণ প্রকাশভঙ্গি, সংলাপ এবং গতিবিধিকে সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়ভাবে দৃশ্যায়িত করে যাবে—যাতে করে গ্রন্থনার পরে সিনটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে বাস্তবানুগ হয়, অথচ ক্যামেরার উপস্থিতি সরাসরি প্রতীয়মান হবে না'। আর সুনিপুণভাবে এই দৃশ্যায়নের কাজটি করেন একজন দক্ষ সিনেমাটোগ্রাফার বা 'ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি'—যিনি চলচ্চিত্রের দৃশ্য, দৃশ্যের গল্প এবং চরিত্রের পাল্স ধরতে সক্ষম। আর তা করতে না পারলে তিনি দৃশ্যের ফটোকপি করার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারবেন না।
আনোয়ার হোসেন এই ক্ষেত্রেও নিজের মুনশিয়ানার পরিচয় দিলেন। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে তিনি বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন 'সূর্য দীঘল বাড়ী' (১৯৭৯), 'দহন' (১৯৮৫), 'নদীর নাম মধুমতী' (১৯৯৬), 'অচিনপাখী' (১৯৯৬), 'চিত্রা নদীর পারে' (১৯৯৮), 'লালসালু' (২০০১), 'শ্যামল ছায়া' (২০০৪), 'চাকা' (১৯৯৩)সহ মোট ১৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ৩০টি প্রামাণ্যচিত্রে। দৃশ্যশিল্পী ও সাংবাদিক জাহাঙ্গীর আলমের মতে, 'ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন আনোয়ার হোসেন ছবি তোলা শুরু করেন এবং আশির দশকে চিত্রগ্রহণে দক্ষতা অর্জন করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি ও সিনেমার ইতিহাস এক নতুন মোড় নেয়'। যদিও স্থিরচিত্র আর চলচ্চিত্রের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখেননি আনোয়ার হোসেন। তার কাছে সিনেমাটোগ্রাফি ছিল 'এক্সটেনশন' মাত্র। তার মতে, 'ছবি যখন তুলি ওটা একটা জিনিস আর চলচ্চিত্রে সেই ছবিগুলো আরো বেশি কথা বলবে।…এর ভেতরে কেমন একটা সিনেমাটিক ধারা আছে, মানে একটা গল্প বলা টাইপের, একটা থিম পরস্পরের সাথে যাচ্ছে'।
জার্মান-মার্কিন চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক হুগো মুনস্টারবার্গের মতে, বাস্তবকে অনুকরণ করার সহজাত বৈশিষ্ট্য চলচ্চিত্রের রয়েছে। তবে বাস্তবতাকে ধারণ করতে গিয়ে শৈল্পিক সৌন্দর্য ও রস উৎপাদন করে। ওদিকে ফরাসি তাত্ত্বিক জাঁ এপস্টেইনের মতে, চলচ্চিত্র হলো একটি কাব্যিক শিল্পমাধ্যম যা নতুন ধরনের বাস্তবতা—অসত্য, অবাস্তব ও পরাবাস্তব প্রকাশে সক্ষম। আমরা দেখি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আনোয়ার হোসেনও কৃত্রিম দিয়ে অকৃত্রিম শিল্প তৈরির পক্ষে। যেমন তিনিও বলছেন, 'মেকির মধ্যেও এতো সত্য কথা বলা হয়, এতো আত্মার ব্যাপার আসে, যেটা আর মেকি মনে হয় না। মানুষ দু লাইন পড়ে, দুটো ছবি দেখে, বইয়ের দুটো পাতা উল্টায়। কিন্তু চলচ্চিত্রের অর্ধেক মিনিট যাওয়ার পর বা দু মিনিট যাওয়া পর ওটার মধ্যে মিশে যায়'।
রূঢ় সত্য হলো, মহান শিল্পীকে তার শিল্পকর্ম ছাড়িয়ে যায়। শিল্পীকে মনে রাখা হয় তার কর্মের মাধ্যমে। শিল্পকর্মই তার স্বাক্ষর এবং অস্তিত্বের প্রমাণ। আনোয়ার হোসেনের বেশিরভাগ ফটোবুক বেরিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্মারক হিসেবে। এজন্য সেগুলো সাধারণ মানুষের হাতে নেই, সেগুলোর দ্বিতীয় কোনো মুদ্রণ বা সংস্করণও হয়নি। আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা বলে, দিন যতো যেতে থাকবে ততোই পুরোনো ছবির মতো আবছা হতে থাকবেন আনোয়ার হোসেন। আর তা হলে, এতো আলোচনা, এতো আয়োজন এবং শিল্পীকে সম্মান জানানোর প্রয়াস—সবই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই এখনই অন্তত তার আলোকচিত্রের একটি সংকলন হওয়া উচিত। ছবি থাকলেই আনোয়ার হোসেন থাকবেন। আর সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া—কার এতো গরজ বলুন, নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখবে! বেঁচে থাকতে যে আমরা তাকে খুব সম্মান দেখিয়েছি—তা নয়। ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ছিলেন না, 'জ্বি হুজুর' 'জ্বি হুজুর' করেননি বলেই হয়তো একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় আলোকচিত্রী হয়েও পাননি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক। আসুন এখন অন্তত ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করি।
তথ্যসূত্র:
দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) – শামসুর রাহমান
দৃশ্যপট বার্ষিক সংকলন ১৪১০ – মাহমুদুল হোসেন সম্পাদিত
কাউন্টার ফটো, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা (৬ ডিসেম্বর, ২০০৪) – সাইফুল হক অমি সম্পাদিত
কামরা (প্রথম খণ্ড), ২০১২ - তানজিম ওয়াহাব ও মুনেম ওয়াসিফ সম্পাদিত
মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র : অবিনাশী দলিল (২০২০) – ড. মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক সম্পাদিত
বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের ইতিহাস (২০০৭) – রফিক হোসেন
আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ ১ : চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি (২০১৮) – আগামী প্রকাশনী
আনোয়ার হোসেনের চিত্রধারণরীতি প্রসঙ্গে, কালি ও কলম (জানুয়ারি, ২০১৯) – সাজেদুল আউয়াল
বাংলা ফটোগ্রাফিসাহিত্যের ধারা (২০২৪) – সুদীপ্ত সালাম
আলোকচিত্রপুর (২০২১) – সুদীপ্ত সালাম
ফটোগ্রাফি ডিকশনারি (তৃতীয় সংস্করণ) – সুদীপ্ত সালাম
Tribute to Anwar Hossain: The End of an Era, The Daily Star (December 6, 2018) - Zahangir Alom
A Ballad of Bangladesh (2004) - Anwar Hossain
IMDb Mini Biography - Shahidul Alam
Anwar Hossian, Artist Talk, Chobi Mela VIII (January 30, 2015)
Comments