পাথর লুটের টাকার ভাগ পেতেন ডিসি–এসপি, জড়িত ৪২ নেতা ও ব্যবসায়ী

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে সাদাপাথর লুটপাটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তালিকায় বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আছেন। এ ছাড়া লুটাপাটে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবির নিষ্ক্রিয়তা ও সহযোগিতা ছিল।
সাদাপাথর এলাকায় এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালিয়ে দুদক এসব তথ্য জানতে পেরেছে। ১৩ আগস্ট দুদক সিলেটের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাতের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এ অভিযান চালায়। পরে অভিযানে পাওয়া যাবতীয় তথ্য প্রতিবেদন আকারে ঢাকায় পাঠানো হয়। এটি গতকাল বুধবার জানাজানি হয়।
এ বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ বলেন, 'সাদাপাথর লুটে বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য নথি খোলার অনুমতি চাওয়া হয়েছে কমিশনের কাছে।' এর বাইরে কোনো বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এনফোর্সমেন্ট অভিযান শেষে দুদক ঢাকায় একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এতে জানানো হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অসাধু ব্যক্তিরা যোগসাজশ করে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে কয়েক'শ কোটি টাকার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করে নেয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে তিন মাস ধরে, পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। সর্বশেষ ১৫ দিন আগে নির্বিচার পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়। এতে প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর তুলে নেওয়া হয়। বর্তমানে এলাকাটি অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে।
ঢাকায় পাঠানো দুদকের ঘেঁটে দেখা গেছে, ছয়টি ক্যাটাগরিতে পাথর লুটে জড়িত ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় এবং সরকারি সংস্থাগুলোর কার কী ভূমিকা ছিল, তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নিষ্ক্রিয়তা, লুটেরাদের কাছ থেকে কমিশন নেওয়াসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
যে ছয়টি ক্যাটাগরিতে দুদক পাথর লুটের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতার বিবরণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এ ক্রমে প্রথমেই আছে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। এরপর স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, রাজনীতিবিদ ও অন্যরা রয়েছেন। এর মধ্যে বিএমডি ও বিজিবির বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করা যাবে বলে দুদক উল্লেখ করেছে।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানকালে সাদাপাথর এলাকায় দর্শনার্থী, ব্যবসায়ীসহ অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এতে তারা জানতে পেরেছে, জেলা প্রশাসক, ইউএনও, সহকারী কমিশনার (ভূমি), তহসিলদারসহ (এ পদের বর্তমান নাম ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা) অনেকেই অবৈধভাবে উত্তোলিত পাথর–বাণিজ্যের কমিশন পান। প্রতি ট্রাক থেকে ৫ হাজার এবং প্রতি বারকি নৌকা থেকে ৫০০ টাকা স্থানীয় প্রশাসন কমিশন পায়।
সিভিল প্রশাসনের ক্ষেত্রে কমিশনের ভাগ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে বণ্টন হয়ে থাকে বলে দুদক অভিযানকালে জানতে পেরেছে। সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও উপজেলা প্রশাসনের নির্দিষ্ট সোর্স ও কর্মচারীর মাধ্যমে কমিশনের টাকা সংগ্রহ করা হয়।
পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও লুটপাট ঠেকাতে সিলেটের জেলা প্রশাসক (গত সোমবার তাঁকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে বদলি করা হয়) মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে বলে দুদক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া ডিসি তাঁর অধীন থাকা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনকে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র রক্ষায় সঠিক দিকনির্দেশনা দিতেও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
গত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় বিশেষ করে সাদাপাথর পর্যটন এলাকায় দিনদুপুরে উপজেলা প্রশাসনের গোচরেই পাথর লুটপাট হয়েছে বলে দুদক উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে, লুটপাট চলাকালে বিভিন্ন সময়ে উপজেলাটিতে চারজন ইউএনও দায়িত্বরত ছিলেন। তাঁরা হলেন আবিদা সুলতানা, ঊর্মি রায়, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত ও আজিজুন্নাহার (গত সোমবার তাঁকে বদলি করা হয়)। তাঁরা নামমাত্র ও লোকদেখানো কিছু ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া পাথর লুট বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেননি।
এদিকে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দিয়েছেন বলে দুদক উল্লেখ করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ এমন, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারি নির্দেশে পাথর তোলা নিষিদ্ধ রয়েছে। অথচ গত ৮ জুলাই বিভাগীয় কমিশনার তাঁর কার্যালয়ে পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, 'সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত।' তাঁর এ বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে তা সাদাপাথর লুটপাটের ক্ষেত্রে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে।
তবে গতকাল বিভাগীয় কমিশনার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় এক মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'গত ৮ জুলাই আমরা ইজারা নিয়ে কথা বলেছি। পাথর চুরি নিয়ে কিছু বলা হয়নি। পাথরচোরদের উৎসাহিত করার মতো কিছু আমি বলিনি। তেমন কিছু কেউ বললে বা ছড়ালে সেটা ভুল মেসেজ।'
এদিকে গত সোমবার বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হয়ে সদ্য বিদায়ী সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ দুই দিন আগে প্রথম আলোকে বলেন, 'সাধ্যমতো পাথর লুট ঠেকাতে চেষ্টা করেছি। আমার কোনো নিষ্ক্রিয়তা ছিল না।' এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জের সদ্য বিদায়ী ইউএনও আজিজুন্নাহার বলেন, 'পাথর লুটকারীদের সহায়তা করে একটি টাকা নিয়েছি—এটা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।'
'ভাগ পান এসপি-ওসিও'
এনফোর্সমেন্ট অভিযানকালে দুদক জানতে পেরেছে, প্রতি ট্রাকে অবৈধভাবে উত্তোলিত প্রায় ৫০০ ঘনফুট পাথর লোড করা হয়। পরিবহনভাড়া ছাড়া প্রতি ট্রাক পাথরের দাম ধরা হয় ৯১ হাজার টাকা। প্রতি ঘনফুট পাথরের দাম ১৮২ টাকা। এর মধ্যে প্রতি ট্রাক থেকে ৫ হাজার টাকা পুলিশ এবং ৫ হাজার টাকা প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। বাকি ৮১ হাজার টাকা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।
দুদক জানিয়েছে, পুলিশের কমিশনের টাকা এসপি, সার্কেল এএসপি, ওসি ও আরও কিছু পুলিশ সদস্য পান। এ ছাড়া অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত প্রতিটি বারকি নৌকা থেকে পুলিশের কমিশনবাবদ ৫০০ টাকা তোলা হয়। পুলিশ নির্দিষ্ট সোর্সের মাধ্যমে প্রতিটি ট্রাক ও নৌকা থেকে এ চাঁদা সংগ্রহ করে।
এদিকে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনানসহ থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের কমিশন গ্রহণ করে সাদাপাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে দুদক পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের এসপি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'যেহেতু তারা (দুদক) বলেছে, তাই তাদেরই এখন বিষয়টা প্রমাণ করতে হবে। একটা মনগড়া, ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে দিলেই তো হবে না।' এ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানীগঞ্জের ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান রিসিভি করেননি। তাই তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি।
Comments