জামালপুর স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া ধরাছোঁয়ার বাইরে

হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দু'হাত ভরে টাকা কামিয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত জামালপুরে চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর নেতারা। জামালপুরের স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণ হতো এই স্বাচিপ নেতাদের ইশারায়। এই পুরো জেলার স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া ছিলেন জামালপুর জেলা স্বাচিপ এর সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও জামালপুর স্বাস্থ্যখাতে চালকের আসনে এই স্বাচিপ নেতারা অবস্থান করছেন। আর্থিকভাবে লাভজনক পদে থেকে স্বাচিপ নেতারা এখনও ঘোরাচ্ছেন ছড়ি। নেপথ্যে তাদের কারণেই জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল সহ সাস্থ্যখাতগুলোতে অস্থিরতা লেগেই আছে।
প্রভাবশালী স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামল ২০০৯ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে দিনে দিনে স্বাস্থ্য খাতের সব প্রতিষ্ঠানে একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন স্বাচিপের এই সভাপতি ও তার সংগঠনের নেতারা। গেল ১৫ বছরের বেশি সময় স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণ করেছেন তারা। জামালপুর স্বাস্থ্য খাতের সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, কেনাকাটা, প্রশিক্ষণসহ সব ক্ষেত্রেই স্বাচিপের হস্তক্ষেপ ছিল অতিমাত্রায়। এমনকি তাদের থাবা বিস্তৃত ছিল বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিক হাসপাতালেও।
সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা রেখে হয়ে উঠেছিলেন জামালপুর জেলার সিভিল সার্জন। এরপর থেকেই তিনি স্বাচিপের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তুলেন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেন।
ক্ষমতার জোরে সরকারি টাকায় নির্মিত সিভিল সার্জন অফিসের কনফারেন্স রুমটির নামও তার বাবা নজরুল ইসলাম এর নামে রাখেন৷তার নিজের মেয়েকেও প্রভাব খাটিয়ে জামালপুর শহরেই রেখেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হওয়ায় ফারুক আহমেদ চৌধুরীর জোর সুপারিশে তিনি
তৎকালীন শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে যোগদান করেন। যোগদান করার পর থেকেই তিনি এই মেডিকেল কলেজের ঠিকাদারদের চাপ সৃষ্টি করে নামে বেনামে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেন। যার ভাগ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী সহ জেলা আওয়ামী লীগের কতিপয় প্রভাবশালী নেতাদের পকেটেও যেতো।
মুখোশের আড়ালে তিনি ছিলেন একজন ভয়ংকর দানব। আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় তিনি উঠাবসা করতেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টও তার ইশারায় দেওয়া হতো। তাকে খুশি করতে পারলেই ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পরিবর্তন করে দিতেন তিনি। এ নিয়ে জেলাজুড়ে সমালোচনা হলেও। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সখ্যতার কারণে ভয়ে কেউ মুখ পর্যন্ত খুলেনি।
সরকার স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করলেও জামালপুরে স্বাচিপ নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল দুরূহ। এক কথায় স্বাস্থ্য খাত ছিল স্বাচিপ নেতাদের হাতের মুঠোয়। তবে এক স্বাচিপের নিয়ন্ত্রণে একক আধিপত্য ছিলো স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতনের।
নিয়োগ কিংবা পদোন্নতির বিষয় এলে ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো ডাক্তারদের। প্রতিটি নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন তালিকা দিয়ে জোরালো তদবির চালাত। তার তালিকার বাইরে কাউকে নিয়োগ দেওয়া সমস্যা ছিল। দিনশেষে তার তালিকার মনোনীতদের পদোন্নতি বা নিয়োগ দেওয়া হতো।
জামালপুর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সরকারি বরাদ্দের ১৬ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ডায়াবেটিস হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন৷ ২০২০ সালের ১৮ জুলাই এই হাসপাতালের উদ্বোধন করা হয়। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী এই হাসপাতালের কর্তৃত্ব নিজের কব্জায় রাখতে ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতনকে পছন্দ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় জামালপুর ডায়াবেটিস হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন তিনি। যোগদান করার পর থেকেই এই হাসপাতালের নিয়োগ বাণিজ্যে তিনি হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। যুব মহিলা লীগের একাধিক নেত্রীকে টাকার বিনিময়ে চাকরী দিলে খোদ জেলা আওয়ামী লীগ অফিসেই এই নিয়ে তখন চলতো নানা সমালোচনা। এছাড়াও এই হাসপাতালের সরঞ্জাম কেনাকাটা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই তাকে দিতে হতো লুটপাটের সমান ভাগ। অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা আওয়ামী তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমেদ চৌধুরী কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করেই তাকে প্রধান নির্বাহী পদে বসান। আর প্রতি মাসে তার নামে বেতনের ২ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে দেওয়া হতো। যা ডায়বেটিস হাসপাতালে এর আগে কেউ এত টাকা বেতনে কাজ করে নি। এছাড়াও তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ডায়াবেটিস রোগীদের পরীক্ষা নিরিক্ষা সহ সবকিছুর দাম দুই গুণ বেশি নেওয়া হতো। সরকার পতনের পর তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিলে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীদের সকল পরীক্ষা নিরিক্ষা আগের তুলনায় এখন অর্ধেক খরচেই হয়ে যায়।
ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন এর শহরের শহীদ হারুণ সংলগ্ন পরিচর্যা ক্লিনিক নামে একটি বেসরকারী প্রাইভেট হাসপাতাল রয়েছে। এই হাসপাতাল থাকার কারণে বেসরকারি প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকেও তিনি তার কব্জায় রেখেছিলেন। তার অধিনস্থ স্বাচিপ ডাক্তারদের কাছে আসা রোগীদের এই হাসপাতালে যেতে বাধ্য করাতেন।
প্রভাবখাটিয়ে ও আওয়ামী লীগের নেতাদের তোষামোদের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক পদে আসীন হোন তিনি। এই পদে থেকে লুটপাট ও দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠেন তিনি। ঢাকায় ৬/৭ টি ফ্ল্যাট সহ নামে বেনামে সম্পত্তি তার। শেখ হাসিনা সরকারের অনেক এমপি মন্ত্রীর সম্পত্তির চেয়ে তার অর্থবিত্ত কোন অংশেই যেন পিছিয়ে নেই।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতনের নেতৃত্বে স্বাচিবের নেতৃবৃন্দ সহ তৎকালীন শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নিয়ে আন্দলোনরত ছাত্রছাত্রীদের দমাতে দিক নির্দেশনা দেন তিনি। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করলে তার দিক নির্দেশনায় সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ছাত্রলীগ বাধা প্রদান করেন। এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতে আওয়ামী ক্যাডারদের আর্থিক সহযোগিতাও করেন তিনি।
ইসলামী আন্দোলন জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি আলহাজ্ব মুফতি মোস্তফা কামাল বলেন, এই স্বাচিপের সভাপতি একজন আওয়ামী লীগের দালাল ছিলেন।জামালপুরের স্বাস্থ্যখাতের সকল লুটপাট স্বাচিপের মাধ্যমেই হয়েছে। অথচ তারা এখনো জামালপুরেই সবাই অবস্থান করছে। আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করছি। সেই সাথে তাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বিভিন্ন সভায় কথা বলেছি। স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন সহ স্বাচিপের দুর্নীতিবাজ সদস্যদের শাস্তি দাবী করছি।
জামালপুর নাগরিক ভয়েসের সভাপতি কাফি পারভেজ বলেন,জামালপুরের স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন সহ স্বাচিপের সকল সদস্যদের দ্বারাই বিগত সরকারের আমলে জেলার স্বাস্থ্যখাত নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। এরা স্বাস্থ্যখাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছেন। তোষামোদির মাধ্যমে বড় বড় পদ দখল করে দুর্নীতির সাথেও সম্পৃক্ত রেখেছিলেন নিজেদেরকে। অথচ এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন বা জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ কোন পদক্ষেপ নেয় নি। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এদের সকল কর্মযজ্ঞ বিচার বিশ্লেষণ করে সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করছি। তাদের শাস্তি দেখে স্বাস্থ্যখাতকে নিয়ে যেন আর কেউ তামাশা না করতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানাই।
জামালপুর জেলা বেসরকারি ক্লিনিক মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ জানান, স্বাচিপের সভাপতি সহ যারা নেতা ছিলেন তারা দীর্ঘ ১৫ বছর স্বাস্থ্যখাতে অনেক দুর্নীতি করেছেন। তারা এখনো প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বীরদর্পে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যারা অতীতে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে দুর্নীতি করেছে, তামাশা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি। স্বাচিপের সকল সদস্যই জামালপুরে আছেন। এরা কম বেশি সবাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত। আর স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন এই দুর্নীতিবাজদের গডফাদার ছিলেন। তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করছি।
গত বছর ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তন হলেও এই স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঢাকায় বসে জামালপুর স্বাস্থ্যখাতকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে জামালপুর জেলা স্বাচিপের সকল নেতাকর্মীদের দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো উপর মহলের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে জেলা স্বাচিপের সকল সদস্যদের জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিষ্ঠানে রেখেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যেই জামালপুরের প্রশাসন দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্যখাতের এই মাফিয়া স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোশায়ের উল ইসলাম রতন ও তার দোসরদের আইনের আওয়াতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবেন।এমনটিই প্রত্যাশা করেন জামালপুরবাসীরা।
Comments