গাজায় আকাশ থেকে ফেলা ত্রাণের প্যাকেটে যা যা থাকে

তিন সন্তানের মা ফিলিস্তিনি আমাল আবু আসসি ত্রাণের একটি প্যাকেট খুললেন। গাজার আকাশে প্লেন থেকে সেটি ফেলা হয়েছিল। প্যাকেটটিতে তিনি যা দেখলেন তাতে হতাশ হলেন!
৩০ বছর বয়সী আমাল বলেন, "এই অপমান আর সহ্য হচ্ছে না... এর জন্য এত কিছু (আকাশ থেকে ফেলা) করার দরকার নাই।"
শিশুদের মাঝে বসে আবু আসসি একটি হুমাসের (মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় একটি খাবার। সিদ্ধ ছোলা দিয়ে তৈরি ঘন ও নরম পেস্ট, যা সাধারণত রুটি বা সবজির সঙ্গে খাওয়া হয়) ক্যান তুলে ধরে বললেন , "এগুলো দিয়ে আমাদের কী হবে? এই হুম্মাসের ক্যানটা— আমি এটা দিয়ে কী করব? আমি কি এটা খুলে এইভাবেই শিশুদের খাওয়াব? এটা স্বাস্থ্যসম্মত না। আমাদের আবার আগের মতো খাবার দরকার। শিশুরা এখন মৃতপ্রায়, ফ্যাকাশে, কঙ্কাল হয়ে গেছে— শরীরে শুধুই হাড়। তারা ভুলে গেছে ডিম, মাংস আর ফল কাকে বলে।"
আপনারা আমাদের কী দিচ্ছেন? কলা— যার এক কেজি ১৫ শেকেল, প্রায় ৪ ডলার, আমরা কোথা থেকে ৪ ডলার পাব? আমরা তো কাজই করতে পারি না যে ২০ শেকেল (প্রায় ৫ ডলার) বা ৪ ডলার আয় করব। পুরুষরা সবাই বেকার, কেউই কাজ করতে পারে না। বাঁচার কোনো উপায় নেই। এখানে জীবন পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। আর না— যথেষ্ট হয়েছে।
"ত্রাণ বিতরণে তারা যেন আগের সেই পদ্ধতিতে ফিরে যায়— সেটা গ্যাস হোক বা কুপনের ব্যবস্থা। যেন আমরা সম্মানের সঙ্গে তা নিতে পারি, আমরা অনুভব করতে পারি যে আমাদের কিছু সম্মান ও মূল্যায়ন আছে। একজন বাস্তুচ্যুত নারী, বয়স্ক পুরুষ, রোগী— সবাই যেন সম্মানের সঙ্গে তাদের সাহায্যের প্যাকেট নিতে পারেন। বাক্সগুলো যেনো তাদের বাড়িতে পৌঁছে যায় বা অন্ততপক্ষে কাছাকাছি এলাকায় আসে। এখন যা হচ্ছে, তা হলো— আমাদের অনেক দূর যেতে হয়, কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয় শুধু সাহায্য নেওয়ার জন্য। অথচ সেখান থেকে মানুষ ফিরে আসে অপমানিত হয়ে, আহত হয়ে, মার খেয়ে।", বলেন আমাল আবু আসসি।
"এই অপমান আর না, সাহায্য বিতরণের আগের সেই পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যান, যেন আমরা সম্মানের সঙ্গে সেগুলো নিতে পারি। এই প্যাকেটগুলো পাওয়ার জন্য আমাদের দৌড়াতে হয়, মরতে হয়। এটা আমাদের তাবুর ওপর, ঘরের ওপর পড়ে, মানুষ একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে, ছুরি নিয়ে দাঁড়ায়। যদি এটা সত্যিই মূল্যবান হতো, তাহলে আমরা নিজেরাই আপনাদের বলতাম— হ্যাঁ, আকাশ থেকে ফেলে দিন। কিন্তু না, আমরা পুরোপুরি এর বিরোধী।'
ফারেস জাহের নামে গাজার এক বাবা ত্রাণের একটি প্যাকেট খুলে দেখাচ্ছিলেন। এসময় পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তার শিশুরা।
তিনি একটা একটা করে জিনিস বের করে তার নাম বলছিলেন- "এটা পাস্তা, এটা মটরশুঁটি, এটা টুনা।" প্যাকেটের মধ্যে আরও কিছু ক্যানজাত খাবার ও লবণ ছিলো।
ফারেস জাহের বলেন, "আমার পরিবারে ৮ জন সদস্য। এই পরিমাণ খাবার দুই দিনেরও জন্য যথেষ্ট নয়। এটা আনতে আমাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জিকিম (উত্তর গাজার একটি সীমান্ত পথ) যেতে হয়। সেখানে আমাদের মারধর করা হয়। আমরা বেশি কিছু চাইছি না— কেবল আমাদের জন্য নিরাপদ করিডোরগুলো নিশ্চিত করুন, তাহলেই হবে। আমরা নিজেদের এবং আমাদের সন্তানদের জন্য কিছুটা নিরাপত্তা চাই।"
"আমরা কীভাবে বাঁচব? আমাদের জানান দয়া করে। যদি আমরা আমাদের সন্তানের জন্য খাবার আনতে না যাই, তাহলে আমরা ক্ষুধায় মারা যাব। কারণ এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যারা খাবার দিয়ে যাবে। আমরা জাতিসংঘ এবং ইউএনআরডব্লিউএকে অনুরোধ জানাই, যেন তারা আমাদের জন্য ত্রাণগুলো বিতরণ করে, আমাদের মেসেজ পাঠায় এবং নিরাপদ করিডোরের ব্যবস্থা করে।"
গাজার বাসিন্দা মোহাম্মদ আবুল আইনিন বলেন, "একটি প্যারাশুট ছাদের ওপর পড়েছিল। তাতে ছাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেতর থেকে খাবার নেয়ার জন্য লোকজন বাড়িতে হামলা চালায়। এভাবে সাহায্য বিতরণ সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না। আগের পদ্ধতিতে আমরা একটি মেসেজ পেতাম, যাতে কুপনের (সাহায্য) জন্য যাওয়া যেত। এখন তো শুধু একটি সাহায্যের প্যাকেটের জন্য লোকজন আমাদের ওপর হামলা করছে— মানুষ ক্ষুধার্ত।"
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) একটি বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। অপুষ্টি বেড়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের ক্ষুধাজনিত কারণে মৃত্যু হচ্ছে। অথচ এই অবস্থায় মানবিক সহায়তা পৌঁছচ্ছে খুবই সীমিত।
গত রোববার (২৭ জুলাই) ইসরাইল বলেছে, তারা গাজার কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টার জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ রাখবে এবং সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খাদ্য ও ওষুধ পরিবহণের জন্য করিডোর নির্ধারণ করে দেবে।
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, গাজায় ২১ লাখ মানুষের দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে প্রতিদিন ৫০০-৬০০ ট্রাক খাদ্য প্রয়োজন।
অথচ জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ঘোষণার পর থেকে মাত্র ১০০টির কিছু বেশি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে।
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম জানিয়েছে, তারা প্রতিদিন ১০০ ট্রাক পাঠাতে চাইলেও মাত্র অর্ধেক প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে। মে মাসে বন্ধ হওয়া রুটির দোকান ও কমিউনিটি কিচেনগুলো পুনরায় চালু করতে পারেনি তারা।
এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি শিশু গুরুতর অপুষ্টির কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইপিসি।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, তারা জরুরি ভিত্তিতে রেডি-টু-ইউজ থেরাপিউটিক ফুড, যেমন পিনাট পেস্ট ও উচ্চ-ক্যালরি বিস্কুট সরবরাহে কাজ করছে; যা তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের আগে প্রয়োজন।
ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের থেরাপিউটিক ফর্মুলা প্রয়োজন, যা পেস্টের মতোই কাজ করে।
ইউনিসেফ জানায়, এই বিশেষ খাদ্য সামগ্রী আগস্টের মাঝামাঝি নাগাদ শেষ হয়ে যাবে।
অপুষ্ট শিশুদের প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক লাগে, যার সরবরাহও শেষ হয়ে আসছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা সাধারণত ৮-১০ সপ্তাহে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তবে দুই বছরের নিচে যারা, তাদের ক্ষেত্রে পূর্ণ সুস্থতা কঠিন, কারণ তখন মস্তিষ্কের বিকাশ হয়।
সব ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদে ফল, শাকসবজি, মাংস ইত্যাদি পুষ্টিকর খাদ্যের প্রবেশাধিকার থাকা জরুরি; যা ব্যবসায়িক সরবরাহ পুনরায় চালু ছাড়া সম্ভব নয় বলে ইউনিসেফ জানায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল-সমর্থিত বেসরকারি সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) জানিয়েছে, তারা মে মাসের শেষ থেকে ৯ কোটি ৬০ লাখের বেশি খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। তাদের প্যাকেটে ছিল- চাল, ময়দা, পাস্তা, টুনা, বিনস, বিস্কুট ও রান্নার তেল।
তবে এসবের অধিকাংশই রান্না করা প্রয়োজন এবং আইপিসি বলেছে, গাজায় পরিষ্কার পানি ও জ্বালানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
ইসরাইল বলেছে, তারা খাদ্য আকাশপথে নামাতে দেবে। জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত রোববার (২৭ জুলাই) প্যারাস্যুটের মাধ্যমে গাজায় ২৫ টন খাদ্য ফেলেছে।
তবে সবার স্বীকৃতি অনুযায়ী, গাজার প্রয়োজন পূরণে একমাত্র কার্যকর উপায় ট্রাক। আকাশপথে খাদ্য দেওয়া অনেক বেশি ব্যয়বহুল। ইউনিসেফ বলেছে, এতে যে আগে পৌঁছে সেই খায়, সবচেয়ে ক্ষুধার্তরা খাবার পায় না।
সহায়তা সঠিকভাবে সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর উপায় খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে সংস্থাটি।
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও পূর্ব ইউরোপে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আঞ্চলিক পরিচালক সামের আবদেলজাবের বলেন, "বিশেষ করে এই মুহূর্তে, যখন আমরা চরম সংকটাপন্ন পর্যায়ের কথা বলছি, তখন সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র কার্যকর উপায় হলো স্থলপথ। আমরা বিশ্বাস করি, এটা বেশি কার্যকর; যদি মানুষ দেখতে পায় যে, আরও সাহায্য ঢুকছে তাহলে তাদের মাঝে যে উৎকণ্ঠা রয়েছে সেটা কমবে। স্থলপথ ব্যবহার করতে পারলে আমরা প্রতিদিনই সহায়তা পৌঁছে দিতে পারব।"
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ মে ইসরাইল অবরোধ তুলে নেওয়ার পর থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন সহায়তা কার্যক্রমে যেসব ট্রাক সীমান্ত পার হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র এক-অষ্টমাংশ গন্তব্যে পৌঁছেছে।
বাকি ট্রাকগুলো লুট হয়ে গেছে— "কখনো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে, কখনো অস্ত্রধারীদের হাতে জোরপূর্বক।"
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অভ্যন্তরীণ একটি বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে, হামাস ইউএস-তহবিলপ্রাপ্ত ত্রাণ পণ্যের পদ্ধতিগত লুটপাটে জড়িত এমন কোনো প্রমাণ নেই। জাতিসংঘও ইসরাইলের নির্বাচিত সংস্থা জিএইচএফ-এর সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে জিএইচএফ-এর ডেলিভারিগুলো আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী এখন পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে জিএইচএফ-এর সামরিকায়িত বিতরণ কেন্দ্রগুলোর কাছাকাছি।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী এখন পর্যন্ত ১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ নিহত হয়েছে জিএইচএফ-এর সামরিকায়িত বিতরণ কেন্দ্রগুলোর কাছাকাছি।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী স্বীকার করেছে, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে কিছু বেসামরিক মানুষ তাদের গুলিতে আহত বা নিহত হয়েছে। এই পরিস্থিতি এড়াতে নিজেদের সেনাদের এখন আরও ভালো নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে বলেও দাবি করেছে দেশটি।
Comments